ভূমিকা, Introduction
বর্তমানে বহুল আলােচিত বিষয়গুলাের অন্যতম হল ডেঙ্গু জ্বর। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব পুরােনাে হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলােতে এই রোগের নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার এক নতুন মনােযােগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শিশু হোক বা বৃদ্ধ, বিত্তশালী হোক বা দরিদ্র কেউই যেন এই মারণঘাতী রােগের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সেইজন্যই ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে আলােচনা বর্তমানে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
ডেঙ্গু জ্বর কি, What is Dengue fever?
ডেঙ্গু’ মূলত এক স্প্যানিশ শব্দ। এর আক্ষরিক অর্থ হল হাড়ভাঙা জ্বর। ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে এই জ্বরের উৎপত্তি। এই রোগের পেছনে মূলত এক মশাবাহিত একসূত্ৰক আরএনএ (RNA) ভাইরাস রয়েছে। স্ত্রী এডিস মশার কয়েকটি প্রজাতি এই ভাইরাস বহন করে। এগুলাের মধ্যে এডিস ইজিপ্টাই হল অন্যতম। তবে এই মশাগুলো শুধুমাত্র ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসই নয়, বরং ইয়েলাে ফিভারের ভাইরাস, জিকাভাইরাস তথা চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক হিসেবে কাজ করে।
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার, Best article on Environmental pollution and its remedies
ডেঙ্গু জ্বরের আবির্ভাবের ইতিহাস, History of the emergence of dengue fever
ডেঙ্গু জ্বরের আবির্ভাব বেশ পুরােনাে বিষয়। ডেঙ্গু মহামারি সংক্রান্ত বেশ কিছু নির্ভরযােগ্য বিবরণ প্রথমবার পাওয়া গিয়েছিল ১৭৭৯ এবং ১৭৮০ সালে, যখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকা প্রমুখ মহাদেশগুলো এই মহামারির কবলে পড়েছিল। পরবর্তীতে ১৮২৮ সালের দিকে ডেঙ্গু কথাটির প্রচলন শুরু হয়েছিল।
এরপর চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রচেষ্টায় এডিস ইজিপ্টাই মশার পরিবাহিতা সম্পর্কে ১৯০৬ সালে সবাই নিশ্চিত হয়। ১৯০৭ সালের সময়কালে ভাইরাসঘটিত রােগগুলোর মধ্যে ডেঙ্গু রোগটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রামক রােগ হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার কারণে ডেঙ্গুর লক্ষণীয় বিস্তার দেখা গিয়েছিল। ১৯৭০ সালে আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়েছিল এই রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবকেই।
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার, Best composition on Science and Superstition in Bengali
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ, Types of dengue fever
সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর দুই ধরনের হয়। যথা: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর এবং হেমােরেজিকডেঙ্গু জ্বর। উক্ত হেমােরেজিক ডেঙ্গু জ্বরটিকে আবার চার ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে, তা হল গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টু, গ্রেড থ্রি এবং গ্রেডফোর। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরােটাইপও রয়েছে। সেগুলাে হলো- DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4। এদের মধ্যে DEN-2 এবং DEN-3 হল সবচেয়ে মারাত্মক ধরনের সেরােটাইপ।
ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার কারণগুলি কি কি? What are the causes of dengue fever?
কোনো এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির স্ত্রী মশা যদি ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী হয় এবং সেটি যদি কোনাে ব্যক্তিকে কামড়ায় তবে সেইব্যক্তি ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার সেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি কোনাে জীবাণুবিহীন মশা কামড়ায়, তবে সেই মশাটিও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা অর্থাৎ বাহকে পরিণত হয়। কোনো রােগীকে দংশন করার দুই সপ্তাহ পরই সৎক্ৰমণক্ষম হয়ে উঠে সেই বাহক মশা এবং তার গােটা জীবনই সংক্রমণশীল হয়ে থাকে। এইভাবেই মশার মাধ্যমে এক থেকে অন্যের মধ্যে এই রােগটি ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলি কি কি ? What are the symptoms of dengue fever?
যেকোনাে ভাইরাসজনিত জ্বরের মতাে ডেঙ্গুতেও জ্বরের সাথে মাথাব্যথা, কাশি, গলাব্যথা, গাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য ও বমি ভাব থাকে। এছাড়াও হাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়। এই জ্বরে মাথাব্যথার তীব্রতা চোখের পিছনে বেশিথাকে। চোখ ঘুরালে বা আই মুভমেন্টে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুতে উপযুক্ত সবগুলাে উপসর্গ দেখা দিতেপারে।
তবে হেমােরেজিক ডেঙ্গুতে গ্রেড ওয়ানে কোনাে রক্তক্ষরণ হয় না। গ্রেড টুতে চোখ, নাক ও চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বমি ও পেট ব্যথা ক্রমেই বাড়তে থাকে। গ্রেড থ্রি ও গ্রেড ফোরকে একত্রে শক সিনড্রোম বলে। গ্রেডথ্রিতে পালস বা নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ হয়ে আসে। গ্রেড ফোরে নাড়ির স্পন্দন ও রক্তচাপ কোনােটিই পাওয়া যায় না।
শকসিনড্রোম হয়ে গেলে দেহের কোনাে অঙ্গে ঠিকমতাে রক্ত সরবরাহ না হওয়ায় অরগান ফেইল করে। একে বলে মাল্টি অরগান ফেইলিওর ওঠার বিভিন্ন অঙ্গের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তি রচনা, Best composition about Modern life and technology in Bengali
ডেঙ্গু জ্বরের বিভিন্ন পর্যায়, Different stages of dengue fever
ডেঙ্গু সাধারণভাবে তিন পর্যায়ে অতিবাহিত হয়। প্রথম, জ্বর চলাকালীন সময়ে বাকেব্রাইল স্টেজ। এই সময় ভিন্ন মাত্রায় তাপমাত্রা বাড়তে পারে। তবে সাধারণত দেখা যায় জ্বর ছয় দিনের মধ্যে কমে যায়।
এই জ্বরের পরের সময়কে বলা হয় এফেব্রাইল ফেজ অথবা জ্বর পরবর্তী পর্যায়, আবার একে ক্রিটিক্যাল ফেজও বলা হয়। এর কারণ হল, ডেঙ্গুর জটিলতাগুলাে মূলত এসময়তেই শুরু হয়ে যায়। সিভিয়ার ডেঙ্গু এফেব্রাইল অথবা এর ক্রিটিক্যাল পিরিয়ডের সময়, অর্থাৎ রােগের এই প্রভাব মূলত ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম দিনে পরিলক্ষিত হয়। এরূপ অবস্থার লক্ষণগুলাে হলা রক্তচাপ দ্রুত কমে যাওয়া, রক্তবমি হওয়া, কালাে পায়খানা হওয়া, প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত এবং ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বাঁধা।
এসবের সাথে প্রস্রাবের পরিমাণও কম হয়ে যায়, বুকে-পেটে তথা ফুসফুসেও জল জমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। রক্তচাপ কম হয়ে যাওয়ায় ফলে রােগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, প্রায়ই অস্থির আচরণ করে। কখনও কখনও বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ডেঙ্গু রােগের তৃতীয় পর্যায়ে দেহে আর তেমন জ্বর থাকে না। তবে দুর্বলতা গ্রাস করতে পারে আক্রান্তকে। তখন একে ক্রোনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম বলে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত, Best detailed information about Global Warming in Bengali
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা কিভাবে হয়, How is dengue fever treated?
ডেঙ্গু জ্বর হলে এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বা পেটেন্টকৃত কোনাে ওষুধ চিকিৎসা ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। এই রোগের রােগীর চিকিৎসার জন্য প্রথমেই প্রয়ােজন হয় রােগটির সনাক্তকরণ। কারও জ্বর হলে, জ্বরের দ্বিতীয় দিন হতে চতুর্থ দিনের মধ্যেই যদি কেউ রক্ত পরীক্ষা করায় তখন ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন পজেটিভ হলে সেই রােগ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়।
ক্লাসিক্যাল এবং গ্রেড-১ হেমােরেজিক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে নিজ বাড়িতেই চিকিৎসা করা সম্ভব। সাধারণত ডেঙ্গুর এই ধরনের রােগীরা ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে এক্ষেত্রে রােগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়ে কিছুদিন বিশ্রামে থাকা উচিত। যথেষ্ট পরিমাণ জল, শরবত, ডাবের জল এবং অন্যান্য তরল জাতীয় পুষ্টিকর খাবার পান করতে হবে।
তবে আক্রান্ত রোগী যদি খাবার গ্রহণ করতে না পারে তবে তাদের ক্ষেত্রে শিরা পথে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। রোগীর জ্বর কম করার ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট হয়। তবে শরীরে ব্যথা কমাতে এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় কোনাে রকম ওষুধ খাওয়া উচিত না। কেউ বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা বা আইসিইউ তে রাখা উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর রােধে কি কি করণীয়, What to do to prevent dengue fever
ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ঔষধ বা প্রতিষেধক নেই। রোগীর দেহে থাকা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই কেবল এই রোগের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া যেকোনও রােগ প্রতিকার করার চেয়ে প্রতিরােধই হল উত্তম, আর ভয়ংকর ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরােধ করার মূলমন্ত্রই হল-এডিস প্রজাতির মশার বিস্তার রােধ করা।
ডেঙ্গু প্রতিরােধের ক্ষেত্রে প্রথম তথা প্রধান করণীয় হল মশাদের ডিম পাড়ার মত উপযােগী সকল স্থান পরিষ্কার রাখা, মশা নিধন করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। বাড়ির আশেপাশে কোথাও যেন জল না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এডিস মশাগুলো সাধারণত সকাল বা সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে এমন নয় যে দিনের অন্য কোনো সময়ও কামড়াতে পারে না।
তাই সারাদিন শরীরকে ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখা উচিত। প্রয়ােজন হলে মসকুইটো রিপেলেন্টও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া বাড়িঘরের জানালাতে নেটব্যবহার করতে পারেন। দিনে কেউ যদি ঘুমায় তবে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো উচিত।
শিশুদের ক্ষেত্রে হাত পা ঢাকা পোশাক গায়ে দিয়ে স্কুলে পাঠানো উচিত হবে। কেউ যদি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় তবে সেই ব্যক্তিকে সর্বদা মশারির ভেতর রাখা উচিত। এছাড়াও মশা নিধন করার স্প্রে, কয়েল, ধূপকাঠি ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত।
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- মোবাইল ব্যাংকিং, Know in detail about Mobile banking in Bengali
- শরীরচর্চা সেরা রচনা, Best essay on physical exercise in Bengali
- নিজের ব্যক্তিত্ব কে গড়ে তোলার কিছু অনন্য উপায়, Valuable tips to build up your personality in Bengali
- আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) সম্পর্কে বিস্তারিত, Best Details about IVF (In Vitro Fertilization) in Bengali
উপসংহার, Conclusion
মশাদের বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাটা তেমন সহজসাধ্য নয়। তবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকেই বাড়ির চারপাশে মশা বৃদ্ধির অকুস্থল টায়ার, পরিত্যাক্ত পাত্র, ডাবের খোসা ইত্যাদি সবকিছু সরিয়ে রেখে দিতে হবে তথা বাসস্থানের আশপাশে জমে থাকা জল নিষ্কাশন করে রাখতে হবে, কয়েক সপ্তাহ পর পর কীটনাশক ও মশানাশকারী রাসায়নিক ছড়িয়ে দিতে হবে।
তাছাড়াও নিজেরা সাবধান থাকা খুব জরুরী, অন্যদেরকেও এ বিষয়ে সচেতন করা উচিত, তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অবশ্যই স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্তি আবশ্যক।