বিজ্ঞান ও কুসংস্কার, Best composition on Science and Superstition in Bengali


” খালি কলসি দেখলে তুমি যেওনা আর বাইরে, একটা শালিক দেখো যদি খারাপ হবে ভাইরে। লেনদেন যদি রাতে করো ফল হবেনা ভালো, এমন করেই কুসংস্কারে জগতটা আজ কালো। “

ভূমিকা, Introduction 

সারা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বৈজ্ঞানিক উন্নতি অভাবনীয়, কিন্তু এর পাশাপাশি অজস্র কুসংস্কার আজও বাসা বেঁধে আছে বহু মানুষের মনের কোণে। একদিকে ব্যাপক বিজ্ঞানশিক্ষার আয়ােজন চলছে, আর অন্যদিকে ছেয়ে আছে কুসংস্কারের তাণ্ডব। অনেক সময় একই সমাজে, একই কালে, এমনকি একই ব্যক্তির মনের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষা এবং কুসংস্কারের প্রাবল্য একসাথে লক্ষ্য করা যায়, যা অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয়। 

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার,

বিজ্ঞান কি? What is Science?

বিজ্ঞান শব্দটির সাথে পরিচিতির শুরুতেই আমরা জেনেছি যে এই কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল বিশেষ জ্ঞান। বিজ্ঞানের কাজ হল কোন এক অজানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যুক্তি ভিত্তিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বিজ্ঞান হোক অমোঘ সত্য, যেক্ষেত্রে থাকে শুধু বিচার- বিবেচনা তথা যুক্তি দিয়ে বিশেষ জ্ঞান প্রাপ্তি।

একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]  

কুসংস্কার বলতে কী বোঝায়? What do you mean by Superstition?

আক্ষরিক অর্থে দেখতে গেলে, কুসংস্কার কথাটির অর্থ হল ‘কু’ যে সংস্কার, অর্থাৎ খারাপ সংস্কার। অন্যভাবে বলতে গেলে, যেসকল সংস্কার যুক্তিহীন হয় এবং মানবজাতির পক্ষে যেগুলো অহিতকর, সেগুলিকেই বলা হয় কুসংস্কার।

মানুষ বিশ্বাস বা বিভিন্ন ধারণার বশবর্তী হয়ে যেসব কার্যকলাপ করে সেগুলোই হল সংস্কার। যেমন, প্রাচীন সময়ে অতিথিদের দেখে হাত জোড় করে নমস্কার করা হত। এইরূপ ভালো সংস্কারগুলো বর্তমানেও প্রচলিত আছে। এটাই প্রমাণ করে যে সব সংস্কার কুসংস্কার নয়, তবে যেসব আচার বা বিশ্বাসগুলি যুক্তিহীন হয় সেগুলোকেই কেবল কুসংস্কার বলা যায়। যেমন, কোথাও যাত্রাকালে হাঁচিকে অশুভ মনে করা, যাকে কুসংস্কার বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় –

“যে জাতি জীবন হারা অচল অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।” 

কুসংস্কার বলতে কী বোঝায়

বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও বৈজ্ঞানিক চেতনা, Scientific progress and scientific consciousness

যুগ যুগ ধরে নানা ছােটো বড়াে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে বর্তমানের আধুনিক সভ্যতা। প্রাচীনকালে যে সকল মানুষ অরণ্যচারী বা গুহাবাসী ছিল, তারাই আজ আকাশপথে পাড়ি জমাচ্ছে গ্রহে তথা গ্রহান্তরে। আজ আধুনিক বিজ্ঞানের নানা শাখা- উপশাখায় গবেষণা চলছে আর মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি একের পর এক নয়া আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে। তাই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন –

“বিজ্ঞানই বর্তমান জগতের উন্নতির মাপকাঠি, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতেই সভ্যতার অগ্রগতি।”

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

বিজ্ঞানের বিস্ময়, Wonders of Science

প্রাচীনকালের মানবজাতি ছিল প্রকৃতির হাতের পুতুল। প্রকৃতির কাছে অসহায় ছিল তারা। তারপর ধীরে ধীরে সেই গুহাবাসী মানব শিখেছিল আগুন জ্বালানো, এভাবেই ক্রমে মানুষ বিজ্ঞানকে করেছে নিজের চিরসঙ্গী। এরপর থেকেই তারা নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করেছে বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতি কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে সমগ্র বিশ্বের উপর। তাই বলা যায়-

” বৈজ্ঞানিকের গবেষণায় বিশ্ব করে জয়, মানুষের ক্রমজমে প্রজম্নটা রয়। “

মানব মনে বিজ্ঞান মনস্কতা গঠন, Formation of scientific mentality in human mind

আধুনিক সময়কালে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়েও এক বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো অবধি বিজ্ঞানের আলো দেখতে পায়নি, এখনও তারা বিজ্ঞান মনস্ক হতে পারেনি। অনেকেরই জীবনচর্চায় বিজ্ঞানবিমুখতা লক্ষ্য করা যায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিজ্ঞানকে নানাভাবে আরো প্রসারিত করতে হবে।

মানব মনে বিজ্ঞান মনস্কতা গঠন

পঠন এবং পাঠনের দিকে বিজ্ঞানকে আরও বিস্তারিত করে তুলতে হবে। শিল্প, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী- সকলের মধ্যেই বিজ্ঞান মনস্কতার উপস্থিতি প্রয়োজন আছে, কারণ বিজ্ঞান শিক্ষাই মানুষকে সকল প্রকার ভ্রান্তধারণাকে দূর করতে পারবে। এর থেকে মানুষ যুক্তিবাদী এবং বিচারধর্মী হয়ে ওঠে। তাছাড়া সমাজে সাধারণত যে সব অন্যায়-অবিচার লক্ষ্য করা যায় সেইসব বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব থাকার কারণেই হয়।

বাঙালীর উৎসব নিয়ে সেরা রচনা, Best composition on Bengali festivals in Bengali

বিবিধ কুসংস্কারের অস্তিত্ব, Existence of various superstitions

“ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখিতে মুরুব্বিদের মানা, কুসংস্কারে আজও আমারা, চোখ থাকিতে কানা।”

দিনের পর দিন বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটছে, তা সত্ত্বেও প্রকৃত অর্থে মানুষ এখনও অবধি বৈজ্ঞানিক চেতনার অধিকারী হতে পারেনি৷ যথার্থ বৈজ্ঞানিক চেতনার অভাব থাকার কারণে আজও আমরা কুসংস্কারের দাস। বহু মানুষ ভ্রান্ত ধারণা, অন্ধবিশ্বাস ও প্রচলিত কিছু লােকাচারের বশবর্তী হয়ে এমন অনেক কাজ করেন যা হয়তো একেবারেই যুক্তিহীন হয়।

বিবিধ কুসংস্কারের অস্তিত্ব

যেমন – এ্যহস্পর্শ, বারবেলা, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদির সময় বিভিন্ন আচার মেনে চলার প্রবণতা প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি শহুরে অঞ্চলের কিছু পরিবারে আজও অব্যাহত৷ ভূতে ধরা নিয়ে আজও বেশ কিছু মানুষের বিশ্বাস অটুট। এইভাবে কুসংস্কারের বশবর্তী মানুষের চোখেই কিছু মানুষ ডাইনিতে পরিণত হয়। জলপড়া, তাবিজ মাদুলি ইত্যাদির গুরুত্ব দুর্বল মানসিকতার ব্যক্তির মধ্যে খুবই বেশি পরিমাণে রয়েছে। আবার কিছু মানুষের কাছে ওষুধের চাইতে দেবতার চরণামৃতের গুরুত্ব বেশি। 

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali

বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার, Science vs. Superstition

আমরা সকলেরই এই বিষয়ে জ্ঞান আছে যে বিজ্ঞান ও কুসংস্কার পরস্পরের বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত। বিজ্ঞান যেকোনো কিছুর ক্ষেত্রেই যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়, অন্যদিকে কুসংস্কার যুক্তিহীন আচারের উপর ভিত্তি করে নির্মিত।

বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার

এজন্যই বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার একসাথে থাকতে পারেনা। কিন্তু বাস্তবের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে, একই ব্যক্তির মনে বিজ্ঞান ও কুসংস্কার পরস্পর সহাবস্থান করছে। উদাহরণ স্বরূপ, অনেক সময় হাসপাতালগামী একটি অ্যাম্বুলেন্সও সামনের রাস্তা দিয়ে বিড়াল পারাপার করতে দেখলে তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষে দেয়। কুসংস্কারের ফলে অজান্তেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং পারিবারিক জীবনে বহু ক্ষতি হয়, যার ফলে আমাদের মধ্যে অনেকেই নির্বোধের মত ভন্ড সাধুসন্ন্যাসী, ওঝা, জ্যোতিষী বা তান্ত্রিকদের দ্বারা নিত্যদিন প্রবঞ্চিত হয়ে যাচ্ছি। 

খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা, Best composition on the necessity of sports in Bengali 

কুসংস্কার দূরীকরণ, Eliminating Superstition 

“তাগা তাবিজ মাদুলি/সভ্য দুনিয়ার শিকলি।”

 বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারকারী বর্তমান যুগে দাঁড়িয়েও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের আচার আচরণ দেখে উক্ত কথাটিই মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসে। মানবজাতির মন থেকে যদি কুসংস্কার দূর করতে হয় তবে সকলকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তােলা অত্যন্ত জরুরী।

কুসংস্কার দূরীকরণ

শুধুমাত্র বিজ্ঞানের উন্নতি বা বিজ্ঞানশিক্ষার মাধ্যমেই নয়, বরং এরজন্য চাই বৈজ্ঞানিক চেতনা, কারণ আমার আশেপাশেও এমন অনেক মানুষ আছে যারা পেশাগত দিক থেকে বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত থাকলেও প্রতি পদে তারা নানা রকম কুসংস্কার মেনে চলে। সেক্ষেত্রে নিজের বিজ্ঞানমনস্কতা তারা শুধু পেশার মধ্যেই আবদ্ধ করে রেখেছে, মন থেকে তা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।

এই কুসংস্কার সরিয়ে দিতে শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল ব্যক্তির মধ্যেই বৈজ্ঞানিক চেতনা জাগানাের চেষ্টা করা উচিত। কুসংস্কার দূরীকরণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং পূর্বের তুলনায় আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। সকলকে মনে রাখতে হবে যে বিজ্ঞানই হল কুসংস্কারের বিনাশকারী।

যেখানে নিরক্ষতা থাকে সেখানেই থেকে ধর্মন্ধতা ও অন্ধবিশ্বাস,  সেইখানেই হয় কুসংস্কারের রাজত্ব। তাই নিরক্ষতা দূরীকরণের পাশাপাশি মানব মনে বিজ্ঞানচেতনা বৃদ্ধি করতে হবে, যুক্তির ব্যবহারে কুসংস্কারের অসাড়তা সম্পর্কে মানুষকে অবগত হতে হবে।

উপসংহার, Conclusion

“ঠকবে নাকো কুসংস্কারে, আলো জ্বালাও মনের ঘরে।”

বিজ্ঞানের অগ্রগতি যদি মানব মনের অন্ধকার দূর না করতে পারে, তবে বড় বড় আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এর যত অবদানই থাকুক, এর সব কিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সমূহ তখনই সার্থকতা লাভ করতে পারবে যখন সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করবে এবং বৈজ্ঞানিক চেতনার আলােকে আলোকিত হয়ে তারা কুসংস্কারমুক্ত হবে। দিনের পির দিন মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটছে, এর পাশাপাশি উন্নতির পথে হাঁটছে বিজ্ঞান এবং প্রযু্ক্তি।

ঠকবে নাকো কুসংস্কারে, আলো জ্বালাও মনের ঘরে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল কাজের সাথেই বিজ্ঞান এক গভীর সংযোগ স্থাপন করেছে। এখন এই সংযোগ হয়তো আর বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। তবুও আমাদের এই উন্নত সভ্য সমাজ আজও অন্ধবিশ্বাস, ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারের অভিশাপ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। একশ্রেণীর মানুষ এখনও যেন কুসংস্কারের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। তাদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা জাগ্রত করতে হবে, তবেই আমাদের সমাজ পুরোপুরি সভ্য হতে পারবে।

Recent Posts