ভূমিকা, Introduction
শিক্ষা বিস্তারে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব কতটা তা হয়তো বলার দরকার হয়না, কারণ একটি গ্রন্থাগার হল মানব সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তন। সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে স্কুল-কলেজ থেকে মানুষ জরুরী জ্ঞানের অধিকারী হয় বটে, কিন্তু গ্রন্থাগার থেকে মানুষ নানা বিষয় জ্ঞান লাভ করে, তাই এই স্থানটি সকল মানুষের কাছেই স্নেহ সাধনার পীঠস্থান হিসেবে বিবেচিত, বিশেষ করে ছাত্রদের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার হল সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠ। তাই কবিগুরু বলেছেন –
“মহা সমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল
কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে
পারি তো যে সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুদের মত
চুপ করিয়া থাকিত তবে সেই
নিরব মহা শব্দের সহিত এই লাইব্রেরী তুলনা হইত”।
গ্রন্থাগারের মর্মার্থ, Meaning of library
“গ্রন্থের আগার গ্রন্থাগার’,
জ্ঞানভাণ্ডার যারে কয়,
দেশ-বিদেশের জ্ঞানসম্পদ,
চুপিসারে কথা কয়।”
যুগ যুগান্তর ধরে জ্ঞানের ধরা বন্দি হয়ে আছে গ্রন্থের পাতায় পাতায়, লেখকদের চিন্তাগুলো এইভাবেই আবদ্ধ হয়ে থাকে গ্রন্থাগারগুলোতে। সময়ের সাথে সাথে বহু জ্ঞানী মানুষের কথাগুলো পুঁথির পাতায় নিঃশব্দ নীরবতায় বাঁধা পড়ে আছে। বিভিন্ন ছাপাখানার কল্যাণে বছরে বছরে বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, আর সেইসব গ্রন্থগুলো ব্যক্তিগত এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলোতে সংকলিত তথা সংগৃহীত হয়।
এই অমূল্য সংগ্রহগুলোই পরবর্তীতে মানুষের জ্ঞান এবং বিদ্যাচর্চার প্রধান অবলম্বন হিসেবে কাজ করে। প্রাচীনযুগে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশিলা প্রভৃতি। পরে এই বিদ্যাকেন্দ্রগুলিই গড়ে উঠেছিল এক-একটি জ্ঞানসম্পন্ন পুঁথির সংগ্রহশালারূপে।
শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali
গ্রন্থাগারের সুবিধাসমুহ, Library facilities
একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার হল জ্ঞানের নীরব সমুদ্র। তৃষিত পাঠকদের জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করাই হল গ্রন্থাগারের মূল উদ্দেশ্য। গ্রন্থাগারে কালান্তরে বিভিন্ন গ্রন্থের মহাসম্মেলন ঘটে, ফলে পাঠকদের জ্ঞানের বিস্তৃতিও হয় অসীম।
গ্রন্থাগারে সংগৃহীত গ্রন্থগুলোর মধ্য দিয়ে এক হয়ে যায় অতীত ও বর্তমান, আর জ্ঞান সন্ধানী হৃদয়গুলি গ্রন্থাগারে গিয়ে অতীত-বর্তমানের মিলন ঘটিয়ে নতুন ভবিষ্যতের সেতু রচনা করে।
একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার হল একটি জাতির উন্নতির সোপান। গ্রন্থাগারে নারী, পুরুষ বা বয়সের কোনোও বাঁধা থাকেনা, সকলেই সেখানে প্রয়োজন বা সময় কাটানোর জন্য পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো গ্রন্থ পাঠ করতে পারেন। ছোটো থেকে বড় যেকোনো কেউ ইচ্ছে করলেই এখানে এসে গ্রন্থে আবদ্ধ জ্ঞানের অতল সমুদ্রে অবগাহন করতে পারেন।
গ্রন্থাগারের সারি সারি তাকগুলোর মধ্যে জমে থাকে সহস্রাব্দের কথামালা। একটি গ্রন্থাগারের শব্দহীন কারাগারের মধ্যে বন্দী থাকা প্রতিটি গ্রন্থই যুগ যুগ ধরে সভ্যতার আলোকবর্তিকা বহন করে আসছে।
আধুনিক শিক্ষায় ইন্টারনেট, Best use of Internet in Modern education in Bengali
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা, Importance of a library
গ্রন্থাগার হল অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এর মিলনের জন্য নির্মিত এক সেতু যার ভেতর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থসমূহ নদীর স্রোতের মতো যুগ-যুগান্তর ধরে দেশ-দেশান্তরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। একটি গ্রন্থের মাধ্যমে একটি হৃদয়ের ভাবরাশিগুলো
নিঃশব্দে সঞ্চারিত হয় অন্য এক হৃদয়ান্তরে, গ্রন্থাগারকে এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বলা চলে, কারণ এখানে একজন চিন্তাবিদ তার নানামুখী চিন্তার খোরাক খুঁজে পায় এবং এক ভাবুক অনুসন্ধানী পায় তার নানা রকম দুরূহ জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর। হৃদয়ের ক্ষুন্নিবৃত্তিগুলোর এমন বিপুল আয়োজন কি আর কোথাও আছে?
তাই গ্রন্থাগারকে ভাব তৃষিত জ্ঞানপিপাসুদের তৃপ্তিদায়ক অমৃত সরোবর হিসেবে ধরা হয়। গ্রন্থাগার বহু পাঠকের যৌথ প্রতিষ্ঠান, কারণ সেখানে ভিন্ন ধরনের গ্রন্থ পাঠ করার সুযোগ মেলে। তাছাড়া একটি গ্রন্থাগার থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা যে কোনও বিষয়ে গ্রন্থ সংগ্রহ করে তা পাঠ করতে পারেন।
কম্পিউটার শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, What is the Importance of computer education in Bengali
গ্রন্থাগারের দায়িত্ব, Responsibility of a library
“যে হৃদয়ের ভাষা, রেখেছে ভাণ্ডার অপূর্ণ করি,
সে অসংখ্য অক্ষৌহিণী দলে আমি ক্ষুদ্র এক কণা;
সাধ আছে, সাধ্য নেই, প্রচেষ্টা, বাজাব মনোবীণা
অন্ততঃ একদিন, হে গ্রন্থাগার, সাধ্যমত বরি।”
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের গুরুত্ব আধুনিক যুগেও ব্যাপকভাবে রয়েছে। যদিও এর কদর আজ অনেকটাই কম হয়ে এসেছে। বহুকাল ধরে গ্রন্থাগার প্রধানত তিনটি দিক থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করছে, যথা গ্রন্থ সংগ্রহ, সংগৃহীত গ্রন্থগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং দেশ তথা জাতির কল্যাণে সংগৃহীত থাকা গ্রন্থগুলোকে কাজে লাগানো।
প্রতিদিন দেশ-বিদেশে বহু নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থগুলোর মধ্য থেকে জ্ঞানমূলক গ্রন্থ সুষ্ঠুভাবে সংগ্রহ করা হল গ্রন্থাগারের কাজ। গ্রন্থাগারের সংহতি তথা প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে দেশ বিদেশের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলোকে সংগ্রহের জন্য নির্বাচন করা উচিত। তবে নির্বাচিত গ্রন্থগুলো যেন সযত্নে রক্ষিত হয় সেইদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
একটি গ্রন্থাগারের নানা ধরনের পোকার উপদ্রব, প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট কোনো বাধা-বিপত্তি এবং কিছু অসৎ পাঠক এবং গ্রন্থাগার কর্মীদের মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে অনেক সময় বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থ নষ্ট হয়ে যায়। তাই গ্রন্থাগারকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, যাতে আগ্রহী ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন মত গ্রন্থগুলো ব্যবহার করতে পারে।
শিক্ষামূলক উক্তি সমূহ, Educational quotes in Bengali language
ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে গ্রন্থাগারের মূল্য, The value of libraries to students
শিক্ষাগ্রহণ তথা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য গ্রন্থাগার এর মূল্য অপরিসীম। একটি গ্রন্থাগার থেকে যেকোনো শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষ করে স্কুল জীবনের তুলনায় কলেজে পড়াকালীন সময়ে গ্রন্থাগারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি থাকে, কারণ কলেজ জীবনে বয়সের সাথে ছাত্রদের জ্ঞানের সীমা রেখা বাড়তে থাকে এবং তাদেরকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পড়ানো হয়, তাই ভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের জন্য গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অপরিসীম।
কোন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার জন্য শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের উপর নির্ভর থাকলেই চলবে না বরং তার জন্য চাই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পুস্তকের যোগান যা ছাত্রদেরকে দিতে পারে অসীম জ্ঞান। পাঠ্যক্রম ছাড়াও গল্প-উপন্যাস সংক্রান্ত বই ছাত্রছাত্রীরা পড়তে পছন্দ করে। তবে সেক্ষেত্রে এমন সব গল্প-উপন্যাসই পড়া উচিত যার দ্বারা তাদের মনের প্রসার ঘটে এবং এক উন্নত জীবনবোধ জাগ্রত হয়, আর এই সকল ব্যাপার একমাত্র গ্রন্থাগারের মাধ্যমেই সম্ভব হবে।
ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের ভূমিকা, Role of library in school or university
ছাত্র ছাত্রীদের কাছে বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় হল জ্ঞানচর্চার মন্দির স্বরূপ, যেখানে পঠন-পাঠনই হল পূজার মূল মন্ত্র। বিদ্যালয়গুলোতে থাকা গ্রন্থাগারগুলি পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষক তথা ছাত্র-ছাত্রী উভয়কেই সাহায্য করে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করার সময় শিক্ষকগণ যদি কোনো প্রকার প্রশ্ন বা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে পড়েন তবে তারা বিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সাহায্য নিয়ে থাকেন।
তাছাড়াও প্রত্যেক শিক্ষককেই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকা সমকালীন বিশ্ব, বিভিন্ন আধুনিক গবেষণা এবং চিন্তাধরার সম্পর্কে অবগত থাকতে হয়; এক্ষেত্রেও গ্রন্থাগারই ঐতিহ্যগতভাবে তাদেরকে সাহায্য করে। আবার অন্যদিকে দেখতে গেলে শিক্ষার্থীরা যদি পঠন পাঠনের ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম ব্যতীত কোনো গ্রন্থের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে তবে তারা গ্রন্থাগারের মুখাপেক্ষী হয়।
এছাড়া বিদ্যালয় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলো শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন গ্রন্থ দ্বারা প্রতিনিয়ত তাদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এইভাবেই গ্রন্থাগারগুলো বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত পঠন পাঠনের দিক থেকে সহায়তা করে চলে।
বর্তমানের আমাদের দেশে অধিষ্ঠিত কিছু গ্রন্থাগার, Libraries that are currently operating in our country are:
আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি গ্রন্থাগার আছে যেখানে নানা বিষয় সম্পর্কিত গ্রন্থ সংরক্ষিত রয়েছে। সেগুলো হল – এশিয়াটিক সােসাইটির গ্রন্থাগার, কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগার। তাছাড়াও দেশের প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজ এবং স্কুল সহ বড় বড় কিছু শহরে পাঠকদের জন্য ছোটো ছোটো গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
উপসংহার, Conclusion
লোক শিক্ষা প্রসারে গ্রন্থাগার প্রভূত সহায়তা করে। বলতে গেলে গ্রন্থাগার ভিন্ন বিষয় জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষায় অনগ্রসর দেশগুলোতে গ্রন্থাগার লোক শিক্ষার প্রসারে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদাভাবে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
সাধারণত বিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীরা জাতীয় গ্রন্থাগারগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয়, কারণ সেখানে দেশের বিভিন্ন অংশের গ্রন্থ সংরক্ষিত থাকে। তবে জাতীয় গ্রন্থাগারের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচিরও প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য প্রতিটি দেশের সরকারকে জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এবং তার প্রসারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগী হওয়া দরকার।