ভূমিকা
‘বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করছে, যে সংগীত ধ্বনিত করে তুলছে, ভাষা রচিত সেই চিত্র এবং গানই সাহিত্য।’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভাষার জন্মই হয়েছে আমাদের মনের ভাব অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য, আর এই ভাষাকে মহিমান্বিত করে তুলেছে সাহিত্যের স্বপ্নীল ছোঁয়া। সাধারণ কোনো কথাও সাহিত্যিকের স্পর্শে হয়ে উঠে অনন্য সুন্দর। তুচ্ছ একটি কথাও সাহিত্যিকের মুখে এসে যেন এক নতুন জীবন লাভ করে। সাহিত্য যেকোনো ভাষাকে অলংকার, উপমা আর শব্দের ব্যঞ্জনায় দেয় এক শ্রুতিমধুর রূপ। তাই সাহিত্য পাঠ করলে মনের মধ্যে যে বিশালতার সৃষ্টি হয় তা আকাশের বিশালতাকেও হার মানাতে পারে।
সাহিত্য কী ? What is literature?
সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘সহিত’ শব্দ হতে। কথাটির ধাতুগত অর্থ হচ্ছে ‘ মিলন ‘। এই মিলন শুধু ভাবের সাথে ভাষার মিলন নয় বরং এই মিলন হল মানুষের সাথে মানুষের মনের, সুদীর্ঘ অতীতের সাথে বর্তমানের তথা দূরের সাথে নিকটের মিলন। সাহিত্যকে যদি আরো তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, তবে শ্রীশচন্দ্র দাসের ভাষায় বলতে হয়- ” নিজের কথা, পরের কথা, বাহ্য জগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয় তার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য। “
দয়ার প্রতিভু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী – Ishwar Chandra Vidyasagar Biography in Bengali
সাহিত্য পাঠের মূল উদ্দেশ্য, Objectives of studying literature
সাহিত্য পাঠ করার মূল উদ্দেশ্য মানুষের মনকে সজাগ করা। এই জাগরণ মানব মনকে সুশোভিত করে তোলে। মানুষ মাত্রই হল সুন্দরের পূজারী, আর এই সৌন্দর্যই মানব মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। এই জগতে একমাত্র শুদ্ধতম জিনিস হল সাহিত্যই যা মনের গভীরতম স্থানে প্রবেশ করে।
ভালো কোনো কবিতা কিংবা গল্প পড়া হলে তা সহজে আমাদের মন থেকে মুছে যায় না, বরং সাহিত্যে পাঠ করা সেই লেখাগুলো ঠিক যেন স্থান, কাল, পাত্র ভেদে আমাদের মনের পটে বার বার ভেসে ওঠে, আর সাহিত্য ঠিক এইখানেই নিজের উদ্দেশ্যে শতভাগ সফল হয়। তাই বলা যায় যে সাহিত্যের শুদ্ধ চর্চা আমাদের মনকে যেন নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। সাহিত্য পাঠ মানুষের মননকে বিকশিত করে তুলে। তাছাড়া মানবাত্মাকে তৃপ্তি দানের ক্ষেত্রেও সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
অন্যদিকে সাহিত্য চর্চা মানব মনকে সকল জাগতিক ব্যস্ততা থেকে মুক্তি দান করে, আর একটি মুক্ত আত্মা কেবলমাত্র শুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমেই সভ্যতার বাতিঘরে অতন্দ্র প্রহরী হতে পারে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে সাহিত্য পাঠের গুরুত্ব জগতের যেকোনো কিছুর বিচারে শ্রেষ্ঠ হয়।
সাহিত্যের বিস্তৃতি, Expansion of literature
মনকে আনন্দ দেওয়াই হল সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্য। এই আনন্দদানের মধ্য দিয়ে যদি কোনো জ্ঞানার্জন হয় তবেই সাহিত্য পাঠ সার্থকতা লাভ করে, কারণ শুধুমাত্র সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়েই মানবাত্মা খেলা করে এবং তার আনন্দ উপভোগ করে।
সাহিত্য পাঠের বিস্তৃতি সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ” যে দেশে সাহিত্যের অভাব সে দেশের লোক পরস্পর সজীব বন্ধনে আবদ্ধ নয়, তারা বিচ্ছিন্ন।” এই সাহিত্য হল এমন একটি বন্ধন যা অতীতকে বর্তমানের সাথে দারুণভাবে এক করে দিয়েছে, আর এর সূত্রটি ধরেই মানুষ তার শিকড়ের টানে ছুটে যায়। সাহিত্যের বিস্তৃতি যে শুধুমাত্র কবিতার ছন্দে আর গল্পের লাইনে আবদ্ধ তা নয়, বরং সুদূর নীল আকাশের যেমন কোনও সীমানা নেই ঠিক তেমনি সাহিত্যও বিস্তৃত মানব সভ্যতার দিগন্ত থেকে দিগন্তে। “
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জীবনী, Best biography of Bill Clinton in Bengali
মানব জীবনে সাহিত্যের প্রভাব, Role of literature studying in human life
মানুষের আবেগ, চিন্তা, অনুভূতি, ভাব, কল্পনা- এই সবই হল সাহিত্যের উপজীব্য। এইগুলোকে সামনে রেখেই মানব জাতি ক্রমশ এগিয়ে যায় প্রগতির পথে। তাছাড়া বর্তমান সমাজ পরিবর্তনশীল। অন্যদিকে সমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত রদবদল হচ্ছে,
ফলে আমাদের জীবনাচরণেও সেই ধরনের হাওয়া বদল লক্ষণীয়। তবে সাহিত্যের ভূমিকা শুধুমাত্র অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ভবিষ্যতের সময়কালে পৃথিবী কেমন হাওয়া চাই তারও ইশারা পাওয়া যায় সাহিত্য থেকে। সাহিত্যচর্চা করার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক এবং আত্মিক- এই দুইটি সত্তারই উৎকর্ষ সাধন ঘটে।
এছাড়া সাহিত্য যেকোনো ব্যক্তিকে মার্জিত করে তোলে; পাশাপাশি আবেগ, অনুভূতি এবং মূল্যবোধকে তাদের জীবনের জরুরী সামগ্রী করে তোলার প্রেরণা জোগায়। সাহিত্যচর্চা কখনই সফল হতে পারে না যদি সেই সাহিত্য আমাদের মন না জয় করতে পারে।
আমাদের মনকে সুন্দর এবং সজীব করে তোলে এই সাহিত্য। সাহিত্যের মানে হল সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা, জীবনে জীবন যোগ করার রসদ, আর এই চেতনাই হল সমাজের উন্নয়নের মূল বিষয়। অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, বিচারহীনতা- এই সব কিছু সাহিত্য এবং সংস্কৃতির পরম শত্রু তথা সমাজ-প্রগতির প্রবল বাধা। একে অপরের সাথে ভালো আচরণ, সুন্দর কথা এবং মিলে মিশে কাজ করা, পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান, ভালো ব্যবহার, নম্রতা, বিনয়, ভদ্রতা- এগুলোও সাহিত্যের অপরিহার্য অঙ্গ।
কারও বাহ্যিক অবয়ব কখনই মানুষের যথার্থ পরিচয় বহন করে না। সেক্ষেত্রে কোনো মানুষের মনুষ্যত্বই হল প্রধান বিষয়। সাহিত্য সুন্দর, সত্য, আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠক হৃদয়ের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তোলে। সাহিত্যের প্রভাবে কোনো হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিগণও পেতে পারে মহৎ জীবনের আভাস। কোনো পাষাণবৎ মানুষও নতুন করে খুঁজে পেয়ে যায় মনুষ্যত্ব। এছাড়াও কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রেও সাহিত্যপাঠ হয়ে উঠতে পারে একটি কৌশল। সাহিত্যের সান্নিধ্য জীবনকে সৃজনশীল এবং ক্রিয়াশীল রাখতে আবশ্যক। সাহিত্য হল মানুষের মনের চিরকালের মুক্তির সরোবর। তাই সাহিত্য পাঠের চাইতে মহৎ আনন্দ আর কিছু নেই।
সাহিত্য পাঠে কল্পনা শক্তির বিকাশ, Development of imagination power by studying literature
সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেদের কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটানো যায়, আর কল্পনা শক্তির বিকাশ হল সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কোনো চিত্র ধর্মী বর্ণনা এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রের খোঁজ যেকোনো সাহিত্যের মধ্যে যদি পাওয়া যায় তবে তা আমাদের চিন্তাধারার দিক থেকে সেই চরিত্রকে যেন এক ভিন্ন জগতের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
এছাড়াও আমরা যখন কারও জীবনী সাহিত্য পড়ি তখন এক অসীম অনন্তের বার্তা যেন নিজেদেরকে বিস্মৃত করে তুলে। অন্যদিকে ভ্রমণ সাহিত্য পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমাদের মানস ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয়, গল্পের মধ্যদিয়েই কল্পনা শক্তির জোরে আমরা অনেক জায়গায় ঘুরে আসতে পারি।
সাহিত্য আমাদের অবসরের সঙ্গী, Literature is our leisure companion
আমাদের মধ্যে অনেকেরই অবসরের সঙ্গী হল সাহিত্যের বই। অবসর সময়ে বই পড়ে ভালো সময় কাটানো যায়। তাই নিঃসন্দেহে সাহিত্যকে অবসরের সঙ্গী বলা যায়৷ বিভিন্ন বয়সের মানুষই অবসর সময় কাটায় বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ পড়ে।
ছোট্ট শিশুরা রূপকথার গল্পগুলো শুনতে ভালোবাসে, আবার কিশোর বয়সের মানুষ খুঁজে বেড়ায় অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক কিছু রচনা, কারণ এই বয়সের কিশোর কিশোরীরা এইসব রচনার মধ্যে দিয়েই পেয়ে যায় তাদের রোমাঞ্চকর আবেগের খোরাক, আর তরুণ তরুণীরা রোমান্স ধৰ্মী সাহিত্য গল্প খোঁজে, এর মধ্য দিয়ে যেন তারা জীবনের সকল উপকরণকে খুঁজে পায়। অন্যদিকে পরিণত বয়স্ক মানুষজন গল্প আর উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন। তারা এই সকল গল্প আর উপন্যাসের মধ্য দিয়ে জীবনের গভীর তথা তথ্যমূলক বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করে নিতে পারেন।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের উক্তি ও ছবি, Bengali love quotes by Rabindranath Tagore with images and English translation
- জীবন নিয়ে শতাধিক উক্তি, Beautiful Bengali Life quotes with Pictures
- Great Bengali Quotes by Kazi Nazrul Islam
- ৫০০+ বাংলা প্রেমের উক্তি| Top 500 Beautiful Bengali Love Quotes
- অনুপ্রেরণামূলক উক্তি সমগ্র, Bengali Inspirational quotes that will motivate you
উপসংহার, Conclusion
জীবন প্রত্যক্ষ এবং এক কঠিন বাস্তব। তাই সাহিত্য এবং শিল্পকে বাস্তবধর্মী না হয়ে কোনো উপায় নেই। এক্ষেত্রে কথা বলতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী চরণটি উল্লেখ করতে হয়, যেখানে তিনি বলেছেন যে- ” সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। ” আজকের সময় হল বিজ্ঞানের যুগ তথা একাকিত্বের যুগও।
আজকের সময়ের নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্ন জীবনে সাহিত্য পাঠ নিয়ে আসতে পারে অসীম প্রসন্নতা, কারণ সাহিত্যের মাধ্যমে বাস্তব জীবনের এক অসীম আনন্দের ইশারা ফুটে ওঠে, আর এর মধ্য দিয়েই আমরা অনুভব করে নিতে পারি জীবনের এক নতুন মূল্য। তাই বর্তমানের টেকনোলজির যুগে দাঁড়িয়েও সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরতে পারলে হয়তো আমরা ব্যর্থ হব না, কারণ ব্যক্তি তথা ব্যবহারিক জীবনে এর চর্চা অতীব জরুরী। অন্যদিকে সার্থক শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও এটি একান্তভাবে কাম্য।