ভূমিকা, Introduction
যে সব মানুষের অক্ষর জ্ঞান নেই তাদেরকে নিরক্ষর বলা হয়। অক্ষর জ্ঞানের অভাবই নিরক্ষরতা হিসেবে পরিচিত। নিরক্ষরতা হল মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অসহায়ত্ব। নিরক্ষর মানুষজন চোখ থাকতেও অন্ধ হয়, কারণ তারা জ্ঞানের জগতের আলো থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা দর্শন-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদির স্বাদ গ্রহণ করতে অক্ষম। তাদের পুরো জীবনটাই যেন ব্যর্থ। দেশ এবং জাতির উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার কথা তো দূরেই থাক, নিজের ভালো-মন্দ বুঝতেও তাদেরকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। আমাদের সমাজ থেকে এই নিরক্ষরতা দূর করতে হলে সকলকেই এগিয়ে আসা দরকার, বিশেষ করে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের ছাত্র সমাজকে।
নিরক্ষরতার ক্ষতিকর প্রভাব, Harmful effects of illiteracy
বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও নিরক্ষর ব্যক্তিদের হার তেমন হ্রাস পায় নি। এখনও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করলে এমন বহু মানুষ পাওয়া যাবে যারা হয়তো নিজের নাম অবধি লিখতে পারেন না। বর্তমান সময় ডিজিটাল যুগ বলে পরিচিত, দেশে টিপ সই এর চল আর নেই বললেই চলে, কিন্তু এমন একটা স্বাধীন দেশে বসবাসকারী নিরক্ষর জনগণের হার যদি বেশি পরিমাণে থাকে তবে তা জাতির পক্ষে নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর, পাশাপাশি এক লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
এখনকার যুগ বিজ্ঞান এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশের যুগ। দিনের পর দিন সবকিছুই উন্নততর হয়ে উঠছে, আর এমন সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি নিরক্ষর হয়ে থেকে যায়, তবে সেই জাতির উন্নতি বাধা প্রাপ্ত হতে পারে, কারণ জনসাধারণ অশিক্ষিত থাকলে তাদের মনের মধ্যে কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে যায়। তারা সময়ের সাথে তালমিলিয়ে উন্নত ধরনের চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষেত্রেও অক্ষম থেকে যায়। নিরক্ষর ব্যক্তিগণ দেশের উন্নতিতে কি ভালো বা কি খারাপ তা নিয়ে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাই নিরক্ষরতাই দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মূল বাধা।
শিক্ষাবিস্তারে গণমাধ্যমের ভূমিকা, Role of mass media in Education in Bengali
নিরক্ষরতার কারণগুলো, Causes of illiteracy
দারিদ্র্যই হল নিরক্ষরতার প্রথম তথা প্রধান কারণ। আমাদের দেশে বসবাসকারী জনগণ বেশিরভাগই দরিদ্রতার সম্মুখীন, যার কারণে তাদের পক্ষে দুবেলা দুমুঠো ভাতের যোগাড় করাও কঠিন। এরজন্যই তাদের সন্তানেরা প্রাথমিক শিক্ষার কয়েক ধাপ পৌঁছেই স্কুল থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। আগেকার সময়ে শিক্ষাগ্রহণের বালাই ছিলনা বললেই চলে, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার দিকে খুব একটা জোর দেওয়া হতো না।
এছাড়া কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা এবং গোঁড়ামির প্রভাবে আমাদের দেশের মানুষ শিক্ষার আলোতে আলোকিত হওয়ার ক্ষেত্রে এতটা আগ্রহী ছিলনা। কিন্তু এখন যুগের সাথে বহু মানুষ নিজেকে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এগিয়ে এসেছে শিক্ষা গ্রহণ তথা শিক্ষা প্রদানের কাজে, দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে হলে এভাবেই সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে হবে।
আধুনিক শিক্ষায় ইন্টারনেট, Best use of Internet in Modern education in Bengali
সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা, Literacy requirements
কোনো দেশের গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সারা দেশজুড়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ জরুরী, কারণ বর্তমান যুগের নব চিন্তাভাবনায় বিজ্ঞানের প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। তবুও আমাদের দেশের বহু মানুষ এখনও নিরক্ষরতায় ডুবে আছে। তাদের ভাবনা চিন্তার মধ্যে কুসংস্কারের ছোঁয়া থেকে গেছে, ফলে তারা জ্ঞানের তথা বিজ্ঞানের মহিমা থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন। তাই আমাদের দেশের ছাত্রসমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে সকল নিরক্ষর ব্যক্তিদের প্রাচীন যুগের চিন্তাভাবনা থেকে বের করে নতুন যুগে নিয়ে আসার।
সাক্ষরতার দিকে প্রথম ধাপ, First step towards literacy
নিরক্ষরতা সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
“মানুষের অন্ধত্বের মতাে নিরক্ষরতা এই দুর্ভাগা দেশের হতভাগ্য জনগণের সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুরতম অভিশাপ।”
সমাজ থেকে নিরক্ষরতার অন্ধকারকে যদি দূর করতে হয়, তবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষার আলো সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর জন্য জরুরী গণশিক্ষা তথা সার্বজনীন শিক্ষা। প্রথমেই প্রয়োজন অক্ষরজ্ঞান। একটি প্রদীপ থেকে যেমন আরো অনেকগুলো প্রদীপ জ্বালানো সম্ভব, তেমনি একজনকে শিক্ষিত করতে পারলে বা একজনের নিরক্ষরতা দূর করলে সেই একজন থেকে আরও অনেকজন শিক্ষিত হতে পারবে এবং এভাবেই আমাদের দেশ থেকে নিরক্ষরতার আঁধার দূর হবে।
তবে নিরক্ষরতা দূর করতে হলে প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তি তথা ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারি সাহায্য প্রয়োজন যাতে নিরক্ষরদেরকে স্বাক্ষর করে তুলতে গ্রামেগঞ্জে নৈশ বিদ্যালয়, বয়স্কদের জন্য শিক্ষা কেন্দ্র, পাঠ্যবই বিতরণ এবং পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার মত বিভিন্ন কর্তব্য গ্রহণ করতে হবে।
কম্পিউটার শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, What is the Importance of computer education in Bengali
নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়, Ways to get rid of illiteracy
বেঁচে থাকতে যেমন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি প্রয়োজন হয় শিক্ষার। আমাদের দেশ বর্তমান সভ্য দুনিয়ার অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর মত দ্রুত উন্নতি করতে না পারার একটি অন্যতম কারণ হল নিরক্ষরতা।
আমাদের সামাজিক জীবনে নিত্য ঘটা মামলা-মোকদ্দমা, অন্যায়-অপরাধ, জালিয়াতি-জুয়াচুরি ও নীতিহীন সকল অপকর্মের মূলে আছে নিরক্ষরতা। তাই এই নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে দেশকে শিক্ষার আলোতে আলোকিত করতে হবে। আর তা তখনই সম্ভব যখন আমাদের ছাত্রসমাজ শিক্ষিত হবে, কারণ তারাই এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত গঠনের মধ্য দিয়ে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
শিক্ষামূলক উক্তি সমূহ, Educational quotes in Bengali language
বয়স্কদের শিক্ষাদান, Teaching the elderly
শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ নজর দিয়েছে, একইভাবে বয়স্কদের শিক্ষার উদ্দেশ্যেও বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার ফল ধীরে ধীরে পাওয়া যায়, তবে বয়স্কদের শিক্ষাদানের ফল সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যদিও জীবিকা অর্জনকারীদের তথা অন্যান্য বিভিন্ন কারণের দরুন বয়স্কদের পক্ষে লেখাপড়ার দিকে বেশি সময় দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবে মাতৃভাষার সাহায্যে সামান্য কার্যকর জ্ঞান অর্জন করাই তাদেরকে বহুক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। এতে বহির্জগতের সাথে সুপরিচিতি, সাধারণ জ্ঞান লাভ এর ক্ষেত্রেও বয়স্কদের বিশেষ সুযোগ দান করতে পারে। তাই বয়স্কদের শিক্ষাদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী।
ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের কর্তব্য, Duty of student society to eradicate illiteracy
দেশের নিরক্ষরতা দূর করার ক্ষেত্রে ছাত্রদের দায়িত্ব অপরিসীম। বিদ্যালয়ে ছাত্রদেরকে বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দান করা হয়, আর এই স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের ছুটির দিনগুলোতে নিরক্ষর মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাদের অক্ষরজ্ঞান দান করার উদ্যোগ নেয় এবং তাদেরকে শিক্ষার গুরত্ব সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে, তাহলে অনেক সুফল পাওয়া যেতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা নিরক্ষরতা দূর করার কাজে এভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সামাজিক সংকট মোচনের কাজে ছাত্রসমাজ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছে। তাই আজকের ছাত্ররাই পারে জনগনকে নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে সরিয়ে সাক্ষরতার আলোয় টেনে নিয়ে আসতে। সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্য পালনের জন্য ছাত্ররা অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহায়তায় বিভিন্ন প্রচার অভিযান করতে পারে, অথবা বিভিন্ন সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান করে জনগনকে নিরক্ষরতা দূর করার ক্ষেত্রে উৎসাহী করে তুলতে পারে।
প্রয়োজনে ছাত্ররা সংবাদপত্র পাঠ করার মাধ্যমেও নিরক্ষরদের মনে শিক্ষা গ্রহণের প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারে। এছাড়া চাঁদা তুলে দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বই খাতা বিতরণের উদ্যোগ নিতে পারে। তাছাড়াও নিরক্ষরদের মধ্যে সাক্ষরতার আলো প্রজ্বলিত করার জন্য ছাত্রছাত্রীরা রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারে। হার না মেনে বিভিন্ন উপায়ে ছাত্রদেরকে নিরক্ষরতা দূর করার ক্ষেত্রে সমাজকে সচেতন করে তুলতে হবে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণের সুফল, Benefits of eradicating illiteracy
বিশ্বের কোনো উন্নত দেশই নিরক্ষরতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে অমনোযোগী নয়। নিরক্ষরতার সমস্যা সমাধান করার কাজে উন্নত দেশগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধনা করে যাচ্ছে। শিক্ষাই জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে, শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ বিশ্ব জয় করতে সক্ষম হয় ওঠে। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণ দেশের সকলের কাছে একটি প্রধান কাজ হওয়া উচিত। এরজন্য প্রত্যেক পরিবারকে তাদের শিশুদের স্কুলে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রদান করতে হবে। তাছাড়া সরকারকে দরিদ্র তথা মেধাবী ছাত্রদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
উপসংহার, Conclusion
নিরক্ষরতা হল জাতীয় জীবনের এক দুরারোগ্য ব্যাধি, আমাদের দেশ ও জাতির উন্নতির পথের কাঁটা। এই কাঁটা না সরাতে পারলে কখনই দেশ উন্নত হতে পারবে না। নিরক্ষরতা মুক্ত সমাজ বর্তমান সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তাই দেশকে উন্নত করার মহান কর্মযজ্ঞে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং যোগ দিতে হবে সাক্ষরতার আন্দোলনে। নিরক্ষরকে প্রকৃতরূপ সাক্ষর করার দায়িত্ব নিতে ছাত্রসমাজকে এগিয়ে দিতে হবে, মনে রাখতে হবে – ” নিরক্ষর মানুষের হাতে ধরিয়ে দাও বই, এটাই হবে তার জীবন যুদ্ধের হাতিয়ার“। দেশের সকল নিরক্ষর জনগনকে অক্ষরজ্ঞান দান করার মাধ্যমে নিরক্ষরতার অভিশাপ মুক্ত করার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তবেই দেশের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব