কালবৈশাখী রচনা, The best essay on Northwester or Kalbaisakhi in Bengali


আনন্দে আতঙ্ক মিশি,  ক্রন্দনে উল্লাসে গরজিয়া মত্ত হাহারবে, ঝঞ্ঝার মঞ্জীর বাঁধি, উন্মাদিনী কালবৈশাখীর নৃত্য হোক তবে। 

 – কালবৈশাখী কে আহ্বান জানিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উক্ত কথাগুলো লিখেছিলেন নিজের “বর্ষশেষ” কবিতায়। সাধারণ মানুষের কাছে ঝড় ধবংসের প্রতীক, কারণ যখন ঝড় আসে, তখন তা সব কিছু ভেঙ্গে চুরে একেবারে তছনছ করে দিয়ে যায় নিজের দুর্দান্ত গতি এবং প্রচন্ডতা দ্বারা।

কালবৈশাখী রচনা
Pin it

কিন্তু ঝড়ের পরবর্তী সেই ধ্বংসই নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনাকে আবার ত্বরান্নিত করে। ঝড়ের কথায় আমাদের সকলেরই মনে আসে কালবৈশাখীর কথা। কালবৈশাখী হল বৃষ্টিপাত ও বজ্রঝড়ের সমন্বয় যা ভারত তথা বাংলাদেশেরও কিছু কিছু অঞ্চলে হয়ে থাকে। এই ঝড় অনেকসময় জীবনঘাতি রূপও ধারণ করে। অন্যদিকে কালবৈশাখীর সময়কালের বৃষ্টিপাত বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলের ধান, পাট এবং আসামের চা চাষের ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা পালন করে।

কালবৈশাখীর সময়কাল, Kalbaisakhi period

উত্তর পূর্ব ভারতে এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে মার্চ মাস থেকে কালবৈশাখীর ঝড় দেখা যায়। গ্রীষ্ম ঋতুর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আগমন ঘটে এ ঝড়ের। চৈত্র মাসের শেষদিকে অর্থাৎ বসন্তের অন্তিম পর্যায় থেকে জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম অর্থাৎ গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ঝড় দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমগ্র বৈশাখ মাসই এই ঝড়ের কবলে পড়ে এবং প্রায় রোজই ঝড় প্রকৃতির বুকে ডানা ঝাঁপটা দিয়ে যায়। বিকালের দিকে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়, ধুলোবালি উড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই ঝর গাছপালা ভেঙে দিয়ে বেশ কিছু সময়ের জন্য এক তান্ডব নৃত্য চালায়, এবং ধীরে ধীরে দূরে কোথাও চলে যায়। তাই কবিগুরু লিখেছেন –

 “উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা বিপুল নিঃশ্বাসে ।” 

 তবে কালবৈশাখী ঝড় নিয়ে বেশ কয়েকজন কবি বিভিন্ন কবিতা লিখেছেন, কালবৈশাখী ঝড়ের রূপকে কবিগণ কাব্যিক ভাষায় বর্ণনা করেছেন, যেমন কবির কথায় –

কালবৈশাখীর সময়কাল
Pin it

” মড়মড়ে সব ভাঙছে গাছে গড়গড়িয়ে মেঘ, ভয়ে সবাই জড়োসড়ো বাড়ছে ঝড়ের বেগ।বছর জুড়ে গড়ে তোলা হাজার ফুলের বাগ, চৈত্র মাসের শেষ বিকেলে ধ্বংসে ঝড়ের রাগ। “

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

কালবৈশাখীর গতিবেগ, Kalbaisakhi speed

কালবৈশাখী ঝড়ে বায়ুর গড় গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ কিমি থেকেও বেশিও হতে পারে। যদিও কালবৈশাখীর স্থায়িত্বকাল স্বল্পতর হয়, তবে কখনও কখনও দেখা যায় যে এই ঝড় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তান্ডব চালিয়েছে।

কালবৈশাখী ঝড়ের সময়কালে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, ত্রিপুরা, ছত্তিশগড়, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে প্রায়ই বজ্রবৃষ্টি হয়ে থাকে। অন্যদিকে কালবৈশাখীর সময় যেকোন ধরনের বায়ুযান চালানো খুব বিপদজনক হয়ে পড়ে। তাই বিমানচালকেরা সাধারণত কালবৈশাখী ঝড়কে এড়িয়ে চলে। 

কালবৈশাখীর গতিবেগ
Pin it

রঙিন বসন্তের বর্ণময় উক্তি | Beautiful Bengali Quotes, Posts about Spring Season

কালবৈশাখীর নামকররণ, Why Kalbaisakhi is named so 

কাল কথার অর্থ হল ‘ধ্বংস’ এবং এই ঝড়ের উৎপত্তি মূলত বৈশাখ মাসেই হয় বলে কালবৈশাখী নামে একে অভিহিত করা হয়। এই কালবৈশাখীর ঝড় উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত হয়, তাই এটি ইংরেজিতে নরওয়েস্টার নামে অতি পরিচিত।

কালবৈশাখীর জীবনচক্র, Life cycle of Kalabaisakhi

কালবৈশাখী ঝড় সৃষ্টির প্রধান কারণ হল দেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আগত উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু। সাধারণ ঝড়ের সাথে কালবৈশাখী ঝড়ের প্রধান পার্থক্য হল এই যে, এই ঝড়ের সাথে সবসময়ই বিদ্যুৎ চমকায় এবং বজ্রপাত হয়ে থাকে। কালবৈশাখী ঝড়ের জীবনচক্রকে তিন ধাপে ভাগ করা যায় এবং এই ধাপগুলি ঊর্ধগামী বা নিম্নগামী বায়ুস্রোতের মাত্রা তথা গতিবিধির উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়ে থাকে। 

কালবৈশাখীর জীবনচক্র
Pin it

বাঙালীর উৎসব নিয়ে সেরা রচনা, Best composition on Bengali festivals in Bengali

কালবৈশাখীর পর্যায়গুলি, Phases of Kalvaishakhi

কিউমুলাস বা ঘনীপূঞ্জীভবন পর্যায়,

পূর্ণতা পর্যায় এবং

বিচ্ছুরণ পর্যায়।

        কোনো অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠস্থ সূর্যতাপের দাবদাহে অত্যধিক গরম হলে সেখানকার বাতাস হালকা এবং অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এই উত্তপ্ত হালকা বাতাস ক্রমশ উপরে উঠে যায় এবং ধীরে ধীরে শীতল হয়ে কিউমুলাস মেঘ সৃষ্টি করে। তবে বায়ুমন্ডলের অস্থিরতা অব্যাহত থাকার ফলে এই কিউমুলাস মেঘ উল্লম্বভাবে কিউমুলোনিম্বাস নামের কালো মেঘ গঠন করে, এর থেকেই পরবর্তী সময়ে বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হয়।

একটি কালবৈশাখী ঝড় পূর্ণতা লাভের প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর থেকে এর তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং এই ঝড় বিচ্ছুরণ পর্যায়ে প্রবেশ করে। বিচ্ছুরণ পর্যায়ে অতি দ্রুত হারে বাতাসের তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়া, মেঘের মধ্যে প্রচুর জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি ও বায়ুর পুঞ্জীভূত ভাবে ঊর্ধ্বচলনের ফলে কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাবৃষ্টিও হয়ে থাকে। তবে শিলাবৃষ্টি অতিরিক্ত পরিমাণে হলে ফসলের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

কালবৈশাখীর পর্যায়গুলি
Pin it

ঝুলন যাত্রা উৎসবের সমস্ত তথ্য ও শুভেচ্ছাবার্তা, All information and greetings on Jhulan Yatra festival in Bengali

কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস, Kalbaisakhi storm forecast

তাণ্ডব করার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঝড়টি সৃষ্টি হয় বলে আগে থেকে এর পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। তবে কোন অঞ্চলে যদি কিছুদিন যাবৎ ব্যাপক গরম পড়ে তখন আবহাওয়াবিদরা অনুমান করে থাকেন যে উক্ত অঞ্চলে এ ধরনের ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব কোথায় হবে এবং কতক্ষণ ধরে হবে তা আগে থেকে জানিয়ে দেওয়ার মত কোন বৈজ্ঞানিক উপায় এখনও নেই। এই ঝড়টি তৈরি হয় তান্ডবের ৫/৬ ঘণ্টা আগে, তবে গতিপথ কখন কোনদিকে হতে পারে সেটা বলা অনেকসময় খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বিভিন্ন জায়গায় কালবৈশাখীর ভিন্ন নাম, Different names of Kalvaishakhi in different places

দেশ তথা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় কালবৈশাখীর মত ঝড়ের বিভিন্ন নাম রয়েছে। কোথাও একে টর্নেডো বলা হয়, আবার কোথাও এটি সাইক্লোন নামে পরিচিত অথবা কিছু ক্ষেত্রে হ্যারিকেন বা টাইফুন ইত্যাদি নামেও এই ঝড়ের আতঙ্ক বর্তমান।

তবে বাঙালিদের কাছে কালবৈশাখী হল গ্রীষ্মকালের বিকালের ঝড়, যে ঝড় প্রচন্ড গরমের হাত থেকে রক্ষা করে এবং আরাম ও স্বস্তি প্রদান করে। সাধারণত সূর্যের সমগ্র দিনের তাপদাহ থেকে মানবককূল, প্রাণীকূল ও উদ্ভিদকূলকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য বিকালের দিকে কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন ঘটে। এই ঝড় বসন্তের শেষে এসে গ্রীষ্মের শুরুতে নতুন বছরকে আগমন জানিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় জানায়। এই কালবৈশাখী ঝড়ের রূপ বর্ণনায় কবিগুরু লিখেছেন – 

” বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎ চঞ্চুবিদ্ধ  দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল, কালো শ্যেন পাখির মত তোমার ঝড় সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর দোলা সিংহ।”

বিভিন্ন জায়গায় কালবৈশাখীর ভিন্ন নাম
Pin it

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali

কালবৈশাখীর প্রভাব, Effect of Kalvaishakhi

কালবৈশাখী ঝড় ছোট শিশুদের মনে বেশ আনন্দ জাগায়, কারণ ঝড়ের পর তারা আম গাছের নিচে কাঁচা পাকা আম কুড়িয়ে পায়, তাছাড়া কখনো শিলাবৃষ্টি হলে সেই শিলা পাথরগুলো কুড়োতে অনেক মজা পায় তারা। তবে ঝড়ের প্রভাবে অনেকেরই বাড়ি ঘর ভেঙে যায়, কোথাও গাছ ভেঙে পড়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়, আবার অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে অনেক সময় বহু ফসল নষ্ট হয়, তাই কবি বলেছেন –

“কাল বৈশাখী সর্বনাশী হিংসুটে এক ঝড়, দালান কোঠা ছোঁওনা তুমি ভাঙ্গো দুখীর ঘর।নিঃস্ব গরীব কৃষক ভায়ের কষ্টে বোনা ধান, ধ্বংস করে তাদের বুকের সুখকে করো ম্লান।”

     অপরদিকে নদী, খাল, বিল ভরে যায় ফলে জেলেরা অতি সহজে জাল ফেলে অথবা ছিপ দিয়ে অনেক মাছ ধরে বাজারে বিক্রয় করতে পারেন। তাই বলা যায় যে ঝড়ের প্রভাবে কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ, অর্থাৎ অনেকের কাছে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে আবার অনেকের কাছে আয়ের সুযোগ এনে দেয়। এমন দিনে অনেকেই সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে চা এবং মচমচে ভাজাভুজি খেতে পছন্দ করেন, আবার অনেকের খিচুড়ি খাওয়ার প্রবল আকাঙ্খাও জন্মায়।

কালবৈশাখীর প্রভাব
Pin it

উপসংহার, Conclusion 

কালবৈশাখী ঝড় যেন পৃথিবীর এই সুন্দর প্রকৃতির এক অশান্ত রূপ।

কালবৈশাখী ঝড় যেন পৃথিবীর এই সুন্দর প্রকৃতির এক অশান্ত রূপ
Pin it

তবে এই ঝড়ের আগমনে গ্রীষ্মের তাপের প্রখরতা কিছুটা কমে আসে। অনেক আবহাওয়াবিদদের মতে, যে বছরগুলোতে নিয়মিতভাবে কালবৈশাখী ঝড়বৃষ্টি দেখা দেয়, সেই বছর বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতও ভালো হয়, ফলে ফসলের ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।


Recent Posts