ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির জীবনী, Biography of former President of India Pranab Mukherjee in Bengali


প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতা, যিনি এক সময় ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পদেও নিজ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন ছিল প্রায় ছয় দশকব্যাপী।

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির জীবনী

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রারম্ভিক জীবন, Early life of Pranab Mukherjee

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত কীর্ণাহার শহরের নিকটে অবস্থিত মিরাটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ছিল রাজলক্ষ্মী দেবী। সেকালের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর মুখার্জী ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে তিনি প্রায় দশ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরবর্তিতে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য হিসেবে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল অবধি কাজ করেন; একসময় তিনি বীরভূম জেলার কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদও অলংকৃত করেছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রারম্ভিক জীবন

বিশ্ববন্দিত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র জীবনী, Biography of Michael Madhusudan Dutta in Bengali   

শিক্ষাজীবন, Education

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন; উক্ত কলেজটি সেসময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।

শিক্ষাজীবন

কর্মজীবন, Career

প্রণব মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনের প্রথমদিকে একজন কলেজ শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তিতে তিনি কিছুকাল সাংবাদিকের কাজও করেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি এবং নিখিল ভারতবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হিসেবেও কাজ করেন। মাননীয় প্রণব মুখার্জি কর্মজীবনের প্রথম সময়ে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত “বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল” এ ২ বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার আমতলার নিকটে অবস্থিত বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

কর্মজীবন

আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলমের জীবনী, Biography of Shahidul Alam in Bengali

রাজনৈতিক কর্মজীবনে উত্থান, Rise in political career

১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেসের দলের টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর থেকেই রাজনৈতিক কর্মজীবনে তাঁর দ্রুত উত্থান শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর এক বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে নিজের জায়গা করে নেন এবং কিছু কাল পর ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৪ সালের পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। তবে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন।
ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু ট্রিটি সাক্ষরের মত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য এবং অসামান্য প্রজ্ঞা এই বিশিষ্ট বাঙালি রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস দলে তথা দলের বাইরেও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। নিজের দেশের প্রতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনাবিল অবদানের জন্য তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “ভারতরত্ন” ও “পদ্মবিভূষণ” সম্মানে ভূষিত করা হয়, তাছাড়াও শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

রাজনৈতিক কর্মজীবনে উত্থান

করুণাময়ী শ্রীশ্রী মা সারদার জন্ম বৃত্তান্ত ও জীবনী, Biography of Shri Shri Maa Saroda in Bangla

ব্যক্তিগত জীবন, Personal life

প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের দুইজন পুত্র এবং এক কন্যা রয়েছে।

রাজনৈতিক কর্মজীবন, Political career

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ধরে ভারতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম বার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি স্বরূপ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে তিনি কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেছিলেন। ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি হবার পর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।  উক্ত মন্ত্রীত্বকালে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. মনমোহন সিংহ।

ইন্দিরা হত্যার অব্যবহিত পর প্রণব মুখোপাধ্যায়কে এক দলীয় গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের শিকার হতে হয়। সে সময় রাজীব গান্ধীও নিজের ক্যাবিনেটে তাঁকে স্থান দেননি। তাঁকে কিছুকালের জন্য কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামক নিজস্ব একটি দল গঠন করেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সমস্যা মিটমাট করে নেওয়ার পর তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে পি. ভি. নরসিমা রাও তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করলে তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবনের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। পরে তিনি ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

রাজনৈতিক কর্মজীবন

সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনী, Biography of Syed Mujtaba Ali in Bengali

বিদেশমন্ত্রী: অক্টোবর ২০০৬

২০০৬ সালের ২৪ শে অক্টোবর প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। বিদেশ মন্ত্রকে প্রণব মুখার্জির কৃতিত্বগুলি হল- প্রথমে তিনি মার্কিন সরকারের সঙ্গে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অসামরিক পরমাণু চুক্তি সই করেন এবং পরে নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফিকেশন চুক্তি সই না করেই নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ারস গ্রুপ থেকে অসামরিক পরমাণু বাণিজ্য করার অনুমতি আদায় করেন।

অর্থমন্ত্রী

মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় সরকার গঠিত হলে প্রণব মুখোপাধ্যায় পুনরায় অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব লাভ করেন। পূর্বে ১৯৮০-এর দশকে, তিনি একই মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ করেছিলেন। ২০০৯ সালের ৬ ই জুলাই তিনি ভারত সরকারের বার্ষিক বাজেট পেশ করেছিলেন। উক্ত বাজেটে তিনি কয়েকটি কর সংস্কার করার প্রস্তাব রেখেছিলেন, যেমন, ‘অস্বস্তিকর’ ফ্রিঞ্জ বেনেফিট ট্যাক্স ও কমোডিটিজ ট্র্যানজাকশান ট্যাক্সের অবলোপন ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি সমাজ কল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ করেছিলেন, এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকরণ আইন এবং শিশুকন্যাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজ ইত্যাদি। এছাড়াও অর্থবরাদ্দ করেছিলেন বিদ্যুদয়ন প্রকল্প, জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি, তাছাড়া জওহরলাল নেহেরু জাতীয় নগরোন্নয়ন মিশনের ন্যায় পরিকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতেও অর্থবরাদ্দ করেন।

অর্থমন্ত্রী

নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী, Biography of Raja Rammohan Roy in Bengali

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০১২, Presidential election 2012

এনডিএ দলপ্রার্থী ও লোকসভার সাবেক স্পিকার মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। প্রণব মুখার্জি পাঁচ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৯টি ভোট পেয়েছিলেন, অন্যদিকে সাংমা দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৫৮টি ভোট পেয়েছিলেন।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০১২

জীবনাবসান, End of life

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ২০২০ সালের ৯ই আগস্ট রাত্রে নিজের দিল্লির বাড়িতেই শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন, এর পর দিন সকাল থেকেই তাঁর স্নায়ুঘটিত বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাঁ হাত নাড়াচাড়া করতে সমস্যা হতে শুরু করে। পরে ১০ ই আগস্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় দিল্লীর সেনা হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে তাঁর করোনা টেস্ট করা হলে রিপোর্ট পজেটিভ আসে। এরপরে হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ার কারণে ওনার ইমার্জেন্সী ব্রেন সার্জারি করা হয়েছিল। অবশেষে ২০২০ সালের ৩১ শে আগস্ট তিনি জীবন যুদ্ধে হেরে যান।

রচিত গ্রন্থাবলি, Literary works

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি জীবদ্দশায় বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেগুলি হল:

● মিডটার্ম পোল
● বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল
● এমার্জিং ডাইমেনশনস অফ ইন্ডিয়ান ইকোনমি
● অফ দ্য ট্র্যাক, সাগা অফ স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস
● চ্যালেঞ্জ বিফোর নেশন।

বাংলাদেশী আমেরিকান পরিসংখ্যানবিদ,মীর মাসুম আলীর জীবনী, Biography of Mir Masoom Ali in Bengali

উপসংহার, Conclusion

প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, রাজস্ব, পরিবহন, অর্থ, জাহাজ-চলাচল,বিদেশ, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের ন্যায় একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণকারী বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি সারা ভারতের কংগ্রেস সাংসদ এবং বিধায়কদের নিয়ে গঠিত কংগ্রেস সংসদীয় দল ও কংগ্রেস বিধানসভা দলেরও প্রধান ছিলেন। ১৯৮৪ সালে, যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার এক সমীক্ষায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ জন অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন তিনি।

FREQUENTLY ASKED QUESTIONS

প্রণব মুখোপাধ্যায় কে?

প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতা, যিনি এক সময় ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় কবে জন্মগ্রহণ করেন?

১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পিতার নাম কি?

কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়।

প্রণব মুখোপাধ্যায় কততম রাষ্ট্রপতি ছিলেন ?

ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান কবে ঘটে?

২০২০ সালের ৩১ শে আগস্ট।

Recent Posts