সারাবিশ্ব ব্যাপী খেলার জগতের ‘মহাকুম্ভ’ হিসেবে পরিচিত অলিম্পিক প্রতি চার বছরে একবার করে হয়ে থাকে। আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে অনুষ্ঠিত ১২৫ তম আইওসি সভায় ২০১৩ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে টোকিওকে 2020 সালের আয়োজক শহর হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।
অলিম্পিকের এই আসর ২০২০ সালের ২৪ শে জুলাই থেকে ৯ ই আগস্ট এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারী দেখা দেওয়ায় ২০২০ সালের মার্চ মাসে আসরটিকে স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের জন্য অলিম্পিক পুনঃনির্ধারণ করার পরও, বিপণন এবং ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে আসরটি “টোকিও ২০২০” নামেই অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল।
অলিম্পিকের সূচনাকাল, Beginning of the Olympics
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে খ্যাত কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বলতে সর্বপ্রথম যে নামটি সকলের মাথায় আসে, তা নিঃসন্দেহে অলিম্পিকের নাম। প্রাচীন সময়ের নানা দস্তাবেজের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞরা ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে বর্তমান আধুনিক অলিম্পিকের সূচনা কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও, প্রাচীনকালের গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী অলিম্পিকের সূচনা কালের সময় ছিল আরো বহু পূর্বের। এছাড়াও অলিম্পিকের সূচনা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি গ্রিক কিংবদন্তি কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে।
সবার শিক্ষা সর্বশিক্ষা অভিযান, Know about Education for all campaign in Bengali
সবেকিয়ানা থেকে অলিম্পিকের অধুনিকতার যাত্রা, Journey from Tradition to Modernity
১৮৯৬ সালে আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল একেবারে সাবেকি ভাবে। তবে এর চার বছর পর অর্থাৎ ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে মেয়েরাও প্রথম বারের জন্য অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। বিশ্ব বিখ্যাত এই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মহিলা প্রতিযোগীদের অংশগ্রহণ করা বিষয়কে বৈপ্লবিক বললে হয়তো অতিশয়োক্তি করা হবে না।
এর কয়েকটি বছর পর থেকে বিভিন্ন শীতকালীন খেলা যেমন স্কেটিং, আইস হকি, স্কি ইত্যাদি খেলাকে অলিম্পিকের আওতাভুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বে প্রথম শুরু হয়েছিল শীতকালীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতা। ১৯২৪ সালের ফ্রান্সের চ্যামনিক্সে প্রথমবার উইন্টার অলিম্পিকসের আয়োজন করা হয়েছিল। এর পরবর্তী বছর থেকে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের মতই প্রত্যেক চার বছর অন্তর শীতকালীন অলিম্পিকসও আয়োজন করা হয়ে থাকে।
চরিত্র গঠনে খেলাধুলার ভূমিকা, Value of sports in character building in Bengali
টোকিও অলিম্পিক ২০২০, Tokyo Olympics 2020
টোকিও ২০২০ ছিল অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ইতিহাসের প্রথম আসর, যা বাতিল না হয়ে বরং স্থগিত রাখা হয় এবং পরবর্তীতে পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তবে অলিম্পিকের আসরে দর্শকের উপস্থিতি অনুমোদিত ছিল না, তাই আয়োজিত অনুষ্ঠানের সকল দিনই মূলত বিনা কোনো দর্শকের উপস্থিতিতেই সম্পন্ন হয়েছিল। ২০২০ সালের অলিম্পিক জাপানের রাজধানী টোকিওতে ২০২১ সালের ২৩ জুলাই থেকে শুরু হয় এবং দীর্ঘ ১৭ দিন ধরে বিভিন্ন ইভেন্টের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়, একই বছরের ৮ আগস্ট এই অনুষ্ঠানের সমাপন ঘটে।
খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা, Best composition on the necessity of sports in Bengali
অলিম্পিকে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব, Impact of the coronavirus pandemic on the Olympics
২০২০ সালের করোনা মহামারীর ভয়াবহ পরিস্থিতি সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছিল। বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময়ের জন্যই কাজ কর্ম, বিনোদন, হাট বাজারের রমরমা বাণিজ্য সবকিছুই ঝিমিয়ে পড়েছিল। এই মহামারিকালেই টোকিও ২০২০ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অলিম্পিক গেমসের ক্রীড়াবিদ তথা দর্শনার্থীদের উপর কোভিড ১৯ এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল এবং ওই বছরের আয়োজক শহর টোকিও থেকে জোর দিয়ে বলা হয় যে অলিম্পিকের প্রস্তুতির উপর কোভিডের প্রভাব হ্রাস করার জন্য তারা এই রোগের বিস্তার ক্রমশ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন।
আইওসি জানান যে তাদের জাপানি অংশীদার এবং প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০২০ সালে খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন যে “আগামী গ্রীষ্মের পরে জাপান এই আসরটি স্থগিত করতে পারবে না”। সার্স-কোভি-২ মানুষের মধ্যে সরাসরি সংক্রামিত হয় বলে, একটি নিরাপদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করাটা আয়োজকদের কাছে বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীর কারণে মৃত্যুর হারও বেড়ে উঠেছিল, তাছাড়া ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি কোনও কার্যকর টিকা উপলব্ধ ছিল না।
করোনা আক্রান্তের হার বাড়তে দেখে লন্ডনের কনজারভেটিভ মেয়র পদপ্রার্থী শন বেইলি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছিলেন যে, কোভিড-১৯ এর মহামারীর কারণে ২০২১ সালের অলিম্পিক গেমসের আসর সঠিকভাবে আয়োজন করতে সক্ষম হবে লন্ডন। কিন্তু টোকিওর গভর্নর ইউরিকো কোইকে তখন বেইলির এই মন্তব্যটিকে অনুপযুক্ত বলে সমালোচনা করেন।
অন্যদিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইনফেকশিয়াস ডিজিজ (NIID) এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমান অনুসারে উক্ত আসরের সময়কালে জরুরী অবস্থার প্রয়োজন হবে বলেও প্রকাশ করা হয়। এদিকে জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের প্যানেল থেকে প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনেও দেখা গিয়েছিল যে, খেলায় দর্শকদের উপস্থিতির অনুমতি দেওয়া হলে নতুন রোগীর সংখ্যা ক্রমশ দ্রুতহারে উন্নীত হবে।
আড়ম্বরহীন ১২৪ তম অলিম্পিক গেমস, The unpretentious 124th Olympic Games
করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারীর জেরে আড়ম্বরহীন ভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১২৪ অতিক্রান্ত আধুনিক অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠানটি। ওই বছর মেডেল প্রদানের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল করোনোর অতিমারির কারণে। সেবারের বিজয়ীদেরকে পূর্বের নিয়ম মত গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়া হয়নি, বরং তাদের পদকগুলি ট্রেতে করে বিজয়ীদের সামনে নিয়ে এলে, তারা নিজেরাই এক এক করে নিজেদের গলায় পরে নিয়েছিলেন। এমনকি তাদেরকে একে অপরের সাথে হাতও মেলাতে দেখা যায়নি।
টোকিও ২০২০ তে ভারতের প্রাপ্ত সাফল্য, India’s success in Tokyo 2020
টোকিও ২০২০ তে বিশ্বের ২৯৬ টি দেশ যোগদান করেছিল এবং বিভিন্ন খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পদক লাভ করেছিল। টোকিও অলিম্পিকে ভারতের বেশ কিছু খেলোয়াড় বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
২০২০ সালের অলিম্পিক এ ভারত থেকে মোট ১২৪ জন ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন যা ছিল এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ। টোকিও ২০২০ এর ভারতীয় প্রতিযোগীরা ১৮ টি খেলায় ৬৯ টি ইভেন্টের মধ্য দিয়ে ভারতের হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অলিম্পিকের প্রথম দিনেই দীর্ঘ ২১ বছরে পর মহিলা বিভাগের ৪৯ কেজি ওয়েটলিফটিং-এ ভারতের হয়ে রূপো জয় করে ইতিহাস তৈরী করেছিলেন মণিপুরী মীরাবাই চানু। অন্যদিকে খেলার শেষ দিনে জ্যাভলিনে ভারতের একমাত্র সোনা বিজয়ী ছিলেন হরিয়ানার কৃষক পরিবারের ছেলে নীরজ চোপড়া।
এ ছাড়াও হকি এবং ব্যাটমিন্টন সহ টোকিও অলিম্পিকে ওই বছর ভারতের ঝুলিতে এসেছিল মোট সাতটি পদক। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল সোনা, দুইটি রুপোর পদক এবং চারটি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে ভারত অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ২৯৬ টি দেশের মধ্যে ৪৮ নং স্থান অধিকারী হয়।
কুস্তিগীর রবি দাহিয়ার হাত ধরে এসেছিল রূপোর পদক; বক্সিংয়ে লাভলিনা বোরগোহাইঁ, ব্যাডমিন্টনে পিভি সিন্ধু এবং কুস্তিতে বজরং পুনিয়া এনেছিলেন তিনটি ব্রোঞ্জ পদক; উক্ত বছরে টোকিও অলিম্পিকে ১১৩ টি পদক সহ প্রথম স্থান অধিকার করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৮৮ টি পদক অর্জন করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল চিন। টোকিও ২০২০ কে ভারতের অলিম্পিকের ইতিহাসের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বছর হিসেবে ধরা হয়। পদকের বিচারে এবং প্রতিযোগীদের খেলার ধরনের বিচারেও তৈরি হয়েছে এক নতুন ইতিহাস।
- বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজার সমস্ত তথ্য, ইতিহাস ~ Essay on Saraswati Puja in Bengali ( PDF )
- একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]
- সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা, Know about the Necessity to study literature in Bengali
- ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
- বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
শেষ কথা, Conclusion
অলিম্পিক গেমস হল ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা তথা খেলোয়াড়দের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের আসন। তাই অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে আপন ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শনের পাশাপাশি নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব দিতে পারার অনুভূতিটা পৃথিবীর যে কোনো ক্রীড়াবিদের কাছেই নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
আমাদের পৃথিবীর সম্পূর্ণ জনসংখ্যার মধ্য থেকে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উপভোগ করার উদ্দেশ্যে উন্মুখ হয়ে থাকে। অলিম্পিক গেমসের মত সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে অ্যাথলেটরা নিজেদের সেরা দিকটা নিয়ে হাজির হন মঞ্চে। অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় নিজের দেশের নাম উজ্জ্বল করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারা সকল খেলোয়াড়ের কাছেই আনন্দ তথা গর্ব স্বরূপ।