আন্তর্জাতিক নারী দিবস, Know in details about International Women’s Day in Bengali



ভূমিকা, Introduction 

“আমার চোখে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

বিশ্বের ইতিহাস ক্রমশ এগিয়ে চলেছে প্রকৃতি এবং মানুষের সম্পর্কের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। যতবারই ইতিহাসের পট বদল হয়েছে, ততবার সব ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস,

বর্তমানে বিশ্বের মােট জনসংখ্যার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে তার অর্ধেকই নারীরা দখল করে আছেন। সেক্ষেত্রে বিশ্বের অর্ধেক জনশক্তি হিসেবে নারী সম্প্রদায় নিঃসন্দেহে পূর্ণ অধিকারের দাবিদার। তবে সারা বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশে বাসকারী নারীরা বহু অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত রয়েছেন। সেই জন্য নারীদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯১৪ সাল থেকে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস রূপে পালন করা হয়। 

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পটভূমি, International Women’s Day background

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে মার্চ মাসের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু দিনটির পটভূমি রচিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। উক্ত বছরের ৮ই মার্চ আমেরিকার এক পােশাক তৈরির কারখানার নারী শ্রমিকগণ বেতন বৃদ্ধি, কাজ করার উন্নত পরিবেশ তথা ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এবং দিন প্রতি ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল।

কিন্তু তৎকালীন সময়ে শাসক-শােষকরা এই সংগ্রামকে বন্ধ করানোর চেষ্টায় সেই নারী শ্রমিকদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন করে। সকল দমন-পীড়ন উপেক্ষা করেও নারী শ্রমিকরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে এবং ১৮৬০ সালের দিকে গড়ে তুলেছিল ট্রেড ইউনিয়ন। নানামুখী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ নিউইয়র্কের দরজি শ্রমিকরা মিলে নারীদের ভােটদানের অধিকারের দাবিতে এক আন্দোলন শুরু করে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠন থেকে সমর্থন পেয়ে এই আন্দোলনটি আরও জোরালাে হয়ে ওঠে এবং নারীদের ভােটাধিকার ১৯১০ সাল থেকে স্বীকৃত হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পটভূমি

১৯১০ সালে ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুযায়ী ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত বছরের ২৭ শে আগস্ট কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।  সম্মেলনটিতে উপস্থিত ছিলেন ১৭টি দেশ থেকে আসা ১০০ জনেরও বেশি নারী প্রতিনিধি। ক্লারা জেটকিনের নারী দিবস পালনের প্রস্তাবকে সবাই সমর্থন জানিয়েছিলেন।

১৮৫৭ এবং ১৯০৮ সালের শ্রমিকদের সংগ্রামের সূচনার দিন ৮ই মার্চ হওয়ায় এই দিনটিকেই নারী দিবস পালনের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে, ১৯৬০ সালে নারী দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়।

সরস্বতী পূজার শুভেচ্ছা, স্টেটাস, বাণী ও এসএমএস – Bengali Status, Captions & Wishes for Saraswati Puja Photos, Wallpapers

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য, Significance of International Women’s Day

 পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী নারী সংগঠনগুলােও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ সহ নারীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে একমত। এই ঐকমত্যের প্রেরণার উৎস হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দীর্ঘ দশ দশক যাবৎ এই বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশে বাসকারী নারীসমাজ নিজ অধিকার রক্ষার দিন হিসেবে এই বিশেষ দিনটিকে পালন করে এসেছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য

মানবজাতির কল্যাণ নারীজাতির অধিকার প্রাপ্তি এবং নারী উন্নয়নের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, কারণ অর্ধেক জনশক্তি হিসেবে সারা বিশ্বের দক্ষতা এবং মেধার অর্ধ ভাণ্ডার আছে নারীদের কাছেই। নারী এবং পুরুষের সমানাধিকার প্রাপ্তি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব হবে। নারী ছাড়া বিশ্বের সার্বিক অগ্রগতিও বাধাপ্রাপ্ত হবে – এই সত্যটিই হল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মর্মবাণী। সেজন্যই জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্য নিরসন করতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিশেষ তাৎপর্যবহ। কবির কথায়-

“কেন একটাই দিন উদযাপন হবে নারী দিবস বলে?

কেন থাকবে না পুরুষের সাথে সম অধিকার?

নারী পুরুষ লিঙ্গ ভেদে কেন থাকবে ভেদাভেদ? সংবিধান দিয়েছে সম অধিকার, 

তবে কেন দেখা হবে হীন চোখে তোমাদের?”

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali

সমাজে নারী-উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা, The need for women’s development in society

“নারীর ক্ষমাশীলতাকে ভেবোনা অক্ষমতা,

ভদ্রতাকে কখনও ভেবোনা দুর্বলতা”

    নারীদেরকে সমাজে শুধু পুরুষের নম্র সহচরী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে নারী সম্প্রদায় পুরুষদের সঙ্গে প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাল মিলিয়ে চলছে। কখনও বীরাঙ্গনা বেশে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। নানা রকম সাহসিক অভিযানে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে পুরুষের সঙ্গে। রাজনীতিতেও নারীরা আজ পুরুষদের সমক্ষমতায় বিরাজমান, এমনকি তারা দেশের জন্য আত্মদানের গৌরবেও গর্বিনী। অন্যদিকে ধর্মে তথা সমাজসংস্কারের দিক থেকেও নারীদেরর ভূমিকা অনন্য।

তাছাড়া সাহিত্যে-বিজ্ঞানেও বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন নারী সম্প্রদায়। নারীরা সর্বদাই সংগ্রামী জীবনের অংশীদার ছিলেন। তারাই হলেন জীবন-যুদ্ধের অন্যতম শরিক।বস্তুত নারীদের মর্যাদা এবং সমাজে তাদের অবস্থান থেকে সহজেই একটি দেশ কতখানি সভ্য এবং উন্নত হয়েছে তা অনুধাবন করা যায়।

সমাজে নারী-উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা

সেজন্য নারীদেরকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা-শ্রেণি ইত্যাদি সকল বিষয় নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা উচিত। নারীকে সব ক্ষেত্রেই তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক ও যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে, তবেই দেশ সঠিকভাবে উন্নত হয়ে উঠবে। নারীর ক্ষমতায়ন ঘটলে তা ব্যক্তিগত, যুক্তিবাদী তথা সামাজিক রূপ নিতে পারে। 

বাঙালীর উৎসব নিয়ে সেরা রচনা, Best composition on Bengali festivals in Bengali

আমাদের দেশে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচি,  Programs undertaken for the development of women in our country

আমাদের দেশে নারীদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রক থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান কিছু কর্মসূচি হল :

মহিলা শক্তি কেন্দ্র : এই কেন্দ্র থেকে ছাত্রী স্বেচ্ছাসেবীদের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করানোর মাধ্যমে গ্রামে বসবাসকারী মহিলাদের ক্ষমতায়ন ঘটানো হবে।

 বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও : উক্ত কর্মসূচিটি মহিলা তথা শিশুবিকাশ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক – এই তিনটি মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে মহিলাদের জন্য শিক্ষার বন্দোবস্ত সহ প্রসূতি এবং সন্তানসম্ভবাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি এইসব বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এই কর্মসূচিটির মূল লক্ষ্য হল সমাজ থেকে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, কন্যা শিশুদের রক্ষা এবং তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

  উজ্জ্বলা : এই কর্মসূচির লক্ষ্য হল মহিলা তথা শিশু পাচার রোধ এবং উদ্ধার করা মহিলাদের উপযুক্ত সুরক্ষা ও তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এসবের পাশাপাশি, তাঁদেরকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হবে। কিছু ক্ষেত্রে অন্য দেশ থেকে এদেশে পাচার হওয়া মহিলাদেরকেও তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

কর্মরতা মহিলাদের আবাস : এই কর্মসূচির লক্ষ্য হল, নিজ বাসস্থান থেকে দূরে কর্মরতা মহিলাদের সুলভে সুরক্ষিত বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এই আবাসিকদের ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ারের সুযোগও দেওয়া হয়ে থাকে। 

আমাদের দেশে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচি

 হেল্পলাইন : ২০১৫-র পয়লা এপ্রিল থেকে এই কর্মসূচিটি রূপায়িত হয়ে এসেছে । ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জরুরি সমস্যার সম্মুখীন মহিলাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ‘১৮১’ – নম্বরের মাধ্যমে গোটা দেশেই সুবিধাটি প্রদান করা হয়।

স্বধার গৃহ :  যেসব মহিলা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির শিকার হন, তাঁদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচির দ্বারা সংস্থাগত সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

একটি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা, A Visit to a Historical Place – Paragraph in Bengali [ PDF ]  

বিশ্বে নারীর অবস্থান, Position of women in the world

বর্তমান বিশ্ব পা রেখেছে এক নতুন সহস্রাব্দে। তবে গত তিন দশকে আমেরিকা, আফ্রিকা তথা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে শিক্ষাগ্রহণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির দিক থেকে নারী সমাজে উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রগতি এসেছে। তবে তা পুরুষ সমাজ দ্বারা একই সময়কালে অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ নয়।

বিশ্বের উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে নারীসমাজের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। নরওয়ে, ইতালি, ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ডের মত বিভিন্ন উন্নত দেশেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারীরা এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে উন্নয়নমূলক দেশগুলোতে প্রায় ৬০ কোটি নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছেন। বলাই বাহুল্য যে, এই দারিদ্র্যসীমার হার পুরুষের তুলনায় বহুগুণ বেশি।

বিশ্বে নারীর অবস্থান

এই বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই হল নারী সম্প্রদায় এবং সারাবিশ্বের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারীজাতি। তাছাড়া আমাদের দেশ সহ আরো বহু স্থানে নারী সম্প্রদায় লাঞ্ছিত অবহেলিত হচ্ছেন, রোজই তারা নির্যাতনের শিকার, কখনও বা তারা ধর্ষিতা, আবার কখনো অ্যাসিড নিয়ে আক্রমণকারীদের শিকার। তসলিমা নাসরিনের লেখায় –

“নারী নামধারী পণ্য আজ বাজারে বিকোয়

পটল কুমড়ো আলু আর খাসির মাংসের মতো

পায়ে নূপুরের মতো বাজে পুরনো শিকল

অ্যাসিডে পুড়ছে তার মুখ

প্রতিদিন কেউ একজন তাকে ধর্ষণ করছে”

লেখাগুলো খুব ভুল নয়, আমাদের সমাজ থেকে নারী নির্যাতন এখনও সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়নি। এই কারণেই নারীরা এখন অবধি সঠিক মর্যাদা পায় নি। 

উপসংহার, Conclusion

নারীদের ভূমিকা পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়

সভ্যতার ক্রমবিকাশে নারীদের ভূমিকা পুরুষদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তবুও প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের সম অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নারীদের ন্যায্য তথা সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সমাজের অগ্রগতির সাথে নারী সম্প্রদায়ের অগ্রগতি সাধন করা। এজন্য নারী এবং পুরুষ সকল ক্ষেত্রে যদি সমান মর্যাদা এবং অধিকার পায় তবেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের যথাযথ মর্যাদা প্রাপ্তি ঘটবে।

Recent Posts