আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী, Best Biography of Abdul Hamid Khan Bhasani in Bengali



স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকেই অবিভক্ত বাংলায় বহু এমন নেতা তথা রাজনীতিবিদ ছিলেন, যারা বাংলার ইতিহাসে সর্বদাই একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছেন; যাদের আদর্শ, নীতি ইত্যাদি আজও বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি আজও বাংলার বহু নেতার তথা সাধারণ মানুষের মনে অনুপ্রেরণা প্রদানকারী হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসনকালের বিংশ শতাব্দীর পরাধীন ভারতের অন্যতম একজন তৃণমূল রাজনীতিবিদ তথা গণআন্দোলনের নায়ক। 

আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী

মজলুম নেতার পরিবার পরিচয়, Family identity

১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম হাজী শারাফত আলী এবং মাতা বেগম শারাফত আলী। শারাফত আলী ও বেগম শারাফতের পরিবারে ৪ জন সন্তানের জন্ম হয় যাদের মধ্যে একটি ছিল মেয়ে এবং বাকি তিনজন ছেলে। তাদের মধ্যে মোঃ আব্দুল হামিদ খান ছিলেন সকলের ছোট। তাঁর ডাক নাম রাখা হয়েছিল চেগা মিয়া। দুর্ভাগ্যবশত ছেলে-মেয়ের বয়স অনেকটা কম থাকা অবস্থায় পিতা হাজী শারাফত আলী ইহলোক ত্যাগ করেন। এর কিছুদিন পর এক মহামারী দেখা দেয় যাতে মা বেগম শারাফত সহ আবদুলের দুই ভাই ও বোন মারা যায়।

ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান তখন একেবারে একা হয়ে যান। এরপর হামিদ প্রথমে কিছুদিন নিজের চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থেকেছিলেন। সেই সময় ইরাক থেকে এক আলেম তথা ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী এসেছিলেন সিরাজগঞ্জে, হামিদ কিছুদিন কাটান তাঁর আশ্রয়ে।

এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্বে, ১৮৯৩ সালের দিকে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার সুখ্যাত জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে চলে যান। সেখানে তিনি জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম চলে যান। ১৯০৩ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এরমধ্যে ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-সালে দেওবন্দ গিয়েছিলেন মওলানা আবদুল। দীর্ঘ দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। 

মজলুম নেতার পরিবার পরিচয়

পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা জীবনী, Best biography of Meghnad Saha in Bengali   

রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, Political experience

১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে এসেছিলেন, তাঁর ভাষণ শুনে মওলানা আবদুল ভাসানী রাজনীতির দিকে অণুপ্রাণিত হন। এরপর ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এরজন্য তাঁকে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানীও সেই দলে যোগদান করেন। 

আবদুল হামিদ খান ভাসানী জীবদ্দশায় ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাজনীতি এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং দেশের স্বার্থে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনে যে কয়েকজন প্রধান নেতা ছিলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কাজেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা

আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়টাতেই তিনি মাওপন্থী তথা বামধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে ছিলেন। এই কারণে  তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে “রেড মওলানা” নামে সম্বোধন করতেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টির করার মধ্য দিয়ে কৃষকদের মধ্যে তথা সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।

অনেকের মনে তিনি একজন দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তিনি রাজনীতিতে থেকে পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো হবে বাংলাদেশ। অনেকেই তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রকাশ করেন যে, ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে গিয়ে আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের “আস্ সালামু আলাইকুম” বলে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে তিনি অন্য কয়েকজন রাজনীতিবিদের সাথে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আবদুল হামিদ খান ভাসানী অন্যতম। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বেশ কয়েকটি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, সেগুলি হল : খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। 

বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, Best biography of Manik Bandopadhyay in Bengali 

রেড মওলানার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য, Red Maulana’s personal life

রেড মওলানা ১৯২৫ সালে তৎকালীন পরাধীন ভারতের জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বাসিন্দা জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর কন্যা আলেমা খাতুন ভাসানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আলেমা খাতুন পীর মা হিসেবে খ্যাত ছিলেন। আলেমার পিতা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সকল জমি জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য মওলানা ভাসানীর হক্কুল এবাদ মিশনে দান করে দিয়েছিলেন।

রেড মওলানার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য

সুখ্যাত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দ্বিতীয় সহধর্মিনী ছিলেন হামিদা খানম ভাসানী। বগুড়া জেলার কৃষক সংগঠনের রেশ ধরেই মওলানা ভাসানী এবং হামিদার পরিচয় হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হামিদা খানম মত্যুবরণ করেছিলেন। এই দম্পতির ঘরে ১টি ছেলে সন্তান ও ২টি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল।

বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, Best Biography of Tarashankar Bandyopadhyay in Bengali

আবদুল হামিদ খানের সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ড, Social reform activities

আবদুল হামিদ খান রাজনীতির নিয়ে বেশ সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের সাথেও বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি জয়পুরহাট-এর পাঁচবিবিতে মহিপুর হক্কুল এবাদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, পড়ে এই মিশনের অধীনে একটি মেডিকেল, টেকনিক্যাল স্কুল এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে হাজী মুহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, পরে সেটি জাতীয়করণও করা হয়েছিল।

আবদুল হামিদ খানের সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ড

বর্তমানে উক্ত কলেজে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ের বেশ কিছু কোর্স চালু আছে এবং এটি সরকারি কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এছাড়া তিনি আসামে মোট ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। এসব ছাড়াও তিনি শিশুদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্র তথা বেশকিছু কারিগরী শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে তিনি সন্তোষে “সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়” নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন- যা ২০০২ সালে “মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২য় স্থান অধিকার করে আছে।

কিশোর কুমার এর জীবনী, Best biography of Kishore Kumar in Bengali

প্রকাশিত গ্রন্থ, Published books

বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ দেশের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখে জনগণের সেবায় নিজের জীবন নিয়োজিত করেছিলেন। তার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে তিনি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন যা তাঁর জীবদ্দশায় থাকাকালীনই প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থগুলি হল :

দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)

মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)

প্রকাশিত গ্রন্থ

বরেণ্য নেতার মৃত্যু, Death of Abdul Hamid Khan Bhasani

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাংলার এই বরেণ্য নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর

তাঁকে বর্তমান বাংলাদেশের টাংগাইল জেলার তৎকালীন সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত সন্তোষ নামক একটি স্থানের পীর শাহজামান দীঘির পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। সারা দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করে।

যীশু খ্রীষ্ট জীবনী, Best biography of Jesus Christ in Bengali

বরেণ্য নেতার মৃত্যু

সুপরিচিত রাজনীতিবিদের প্রাপ্ত সম্মাননা, Honors received

আবদুল হামিদ খান বাংলার ভাষা আন্দোলনের সময় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, যার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০০২ সালে তাঁকে  মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিবিসি এর জরিপে ২০০৪ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় তিনি ৮ম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হন।

উপসংহার, Conclusion 

অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ছয় দশক ধরে সংগ্রাম করে মওলানা ভাসানী বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন। তাঁর আন্দোলন মূলত ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা তথা সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশি লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, “মওলানা ভাসানী নিজে একজন মওলানা ছিলেন। তিনি পীরও ছিলেন। কিন্তু তিনি ওইখানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি।

তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিল না। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা। স্বাধীনতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সমাজে বৈষম্য দূর করা।” তাই তিনি জনগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে পেরেছিলেন।

Frequently Asked Questions :

আবদুল হামিদ খান কে?

ব্রিটিশ শাসনকালে বিংশ শতাব্দীর পরাধীন ভারতের অন্যতম একজন তৃণমূল রাজনীতিবিদ।

আবদুল হামিদ খান কবে একুশে পদকে ভূষিত হন?

২০০২ সালে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক।

 আবদুল হামিদ খান কবে মৃত্যু বরণ করেন ?

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর।

আবদুল হামিদ খান কোন কোন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন ?

খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।

Recent Posts