” আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা…আর কত কাল আমি রব দিশাহারা….রব দিশাহারা। “
-১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া সলিল চৌধুরীর লেখা এই গানটি আমরা প্রথমবার যার কণ্ঠে শুনেছিলাম তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। জীবদ্দশা থেকে এখনও অবধি তাঁর আধুনিক বাংলা গান এবং রবীন্দ্র সংগীতগুলি সমান খ্যাতি বহন করে এসেছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী, বহু চলচ্চিত্রের নেপথ্য কণ্ঠপ্রদায়ক, অসংখ্য বাংলা তথা হিন্দি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক, বিশিষ্ট সুরকার এবং প্রযোজক তথা পরিচালকও।
জন্ম ও শৈশব, Birth and childhood
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ১৬ ই জুন পবিত্র বারাণসী শহরে নিজের মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিলেন কালিদাস মুখোপাধ্যায় এবং মাতা কিরণবালা দেবী। হেমন্ত কুমারের মাতামহ একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক ছিলেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত জয়নগরে তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল।
পরবর্তীতে ১৯২২ সালে তাঁর পরিবার কলকাতা শহরে চলে আসেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তিন ভাই এবং এক বোন ছিল। বোনের নাম ছিল নীলিমা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শক্তিদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন চাকরিরত, অন্যদিকে সেজো ভ্রাতা তারাজ্যোতি ছিলেন ছোটো গল্প লেখক। হেমন্ত কুমারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অমল মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছিলেন এবং গানও গেয়েছিলেন।
যীশু খ্রীষ্ট জীবনী, Best biography of Jesus Christ in Bengali
ছাত্রজীবনে অধ্যয়নের বিভিন্ন তথ্য, Student life
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়েছিল নাসিরুদ্দিন স্কুল থেকে। পরবর্তীতে ভবানীপুরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে অধ্যয়ন শুরু করেন। সেই স্কুলেই তাঁর সঙ্গে খ্যাতিমান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষের পরিচয় হয়। সেই সময়কালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও ছোটো গল্প লিখতেন, সন্তোষ কুমার লিখতেন কবিতা এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন গানের জগতের সাথে লিপ্ত। পরবর্তী সময়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার উদ্দেশ্যে চলে যান।
এ আর রহমান এর জীবনী, Best detailed biography of A.R. Rahman in Bengali
সংগীত জগতে প্রবেশ, Hemant Kumar in the music world
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মনে একসময় সংগীতের প্রতি মোহ এতটাই বেড়ে যায় যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। জীবনের প্রথমদিকে তাঁর সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। বেশ কিছুদিন দেশ পত্রিকায় বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালের দিক থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন সঙ্গীত জগতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকে সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করতেন প্রখ্যাত গায়ক পঙ্কজ মল্লিককে। তাই তাঁর ডাকনাম রাখা হয়েছিল ‘ছোটো পঙ্কজ’।
প্রথম গান রেকর্ড, First recorded song
বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় ১৯৩৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আকাশবাণীতে প্রথমবার একটি গান রেকর্ড করেছিলেন। “আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী “ ছিল ওই গানটির প্রথম পংক্তি।
এই খ্যাতনামা গায়কের রেকর্ডকৃত প্রথম হিন্দি গানটি হল “কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে ” এবং ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’; এই দুটি গান জিসিআইয়ের কলাম্বিয়া লেবেলে ১৯৪০ সালে প্রকাশ করা হয়েছিল। কমল দাশগুপ্ত ছিলেন উক্ত গানগুলোর সুরকার; গানের কথাগুলো রচয়িতা ছিলেন ফৈয়াজ হাসমি। এর পর থেকে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে খ্যাতি বাড়তে থাকে তাঁর। হিন্দি সংগীত জগতে তিনি হেমন্ত কুমার নামে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- এর জীবনী, Best Biography of Sunil Gangopadhyay in Bengali
চলচ্চিত্রে প্রথম কণ্ঠপ্রদান এবং সুরকার হিসেবে কাজ, Film debut as a composer and voice actor
হেমন্ত মুখোাধ্যায় সিনেমা জগতের জন্য প্রথমবার গান গেয়েছিলেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নামক চলচ্চিত্রে। ১৯৪১ সালে মুক্তি পাওয়া এই বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীতকার ছিলেন হরিপ্রসন্ন দাস। তিনি আঠেরো বছর বয়সকালে নিজের লেখা একটি গানে প্রথম নিজে সুর করেছিলেন। তবে চলচ্চিত্র জগতে ১৯৪৭ সালে প্রথম সুরারোপ করেন, হেমেন গুপ্ত দ্বারা পরিচালিত ছায়াছবি ‘অভিযাত্রী’ তে তিনি সঙ্গীতশিল্পী তথা সুরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন। উক্ত ছবিতে চারটি রবীন্দ্রসংগীত প্রকাশ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে একই সালে তিনি অন্য এক ছবির গানেও সুরারোপ করেছিলেন। এর মধ্যে হেমন্ত কুমার নিজেও দুটি গেয়েছিলেন।
উত্তরাধিকার, Legacy
স্বনামধন্য গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের প্রায় দুই দশক পরও ‘গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া’ প্রতি বছর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানগুলির অন্তত একটা অ্যালবাম প্রকাশ করে, বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা থাকার কারণে তাঁর পুরোনো গানগুলির পুনর্প্রস্তুতকরণ করে তা প্রকাশ করা হয়। জীবদ্দশায় যেসব গান তিনি রেকর্ড করেছিলেন বা যে সুরগুলো তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, বর্তমান সময়ের বেশ কিছু গায়কেরা ভারতে তথা বাংলাদেশও তাঁর গায়কীর ধরনকে অবিরত অনুকরণ করার চেষ্টা করে, এর ফলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার অদ্যবধি জীবন্ত।
ব্যক্তিগত জীবন, Personal life
১৯৪৫ সালে বাংলা সঙ্গীত শিল্পী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। ১৯৪৩ সালের দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে বেশ কিছু গান গাইয়েছিলেন যা অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। কিন্তু বিবাহের পর থেকে বেলা সঙ্গীত জগৎ থেকে দূরে চলে যান। এই দম্পতির ঘরে দুই সন্তানের জন্ম হয়েছিল — পুত্রের নাম জয়ন্ত এবং কন্যার নান রাণু। পরবর্তীতে রাণু মুখোপাধ্যায়ও গানের জগতের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে ১৯৭০ দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হেমন্ত পুত্র জয়ন্ত মুখোপাধ্যায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গান, Some popular songs of Hemant Kumar
বিশ্ববরেণ্য গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অনুমানিক দেড়শোটি বাংলা ছবিতে নিজের সুর দিয়েছেন এবং গানও গেয়েছেন। গায়কের কণ্ঠে গাওয়া বহু গান আমরা বহুবার শুনেছি। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় কিছু গান হল:
● মাগো ভাবনা কেন….
● পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো…..
● ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…..
● মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে….
● ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা, ও বাতাস আঁখি মেলোনা…..
● আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি,আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি….
● এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার….
● মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো…..
● আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে…..
● আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা,আর কতকাল আমি রব দিশাহারা…..
● ওলিরও কথা শুনে বকুল হাসে….
● ছেলে বেলার গল্প শোনার দিনগুলো…..
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের জীবনী, Best Biography of President Joe Biden in Bengali
পুরস্কার প্রাপ্তি, Awards received and recognitions
দেশ বিদেশে নিজের সুরের তথা কণ্ঠের জাদু ছড়িয়ে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বহু পুরস্কারের অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার সমূহ তথা সম্মাননাগুলি হল :
● ১৯৭০:পদ্মশ্রী(অস্বীকৃতি)
● ১৯৮৭:পদ্মভূষণ(অস্বীকৃতি)
● ১৯৫৬: ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড: নাগিন
● ১৯৭১: ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার: নিমন্ত্রণ
● ১৯৮৬: ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার: লালন ফকির
● ১৯৬২: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড স্বরলিপি – বিজয়ী
● ১৯৬৩: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড (হিন্দি); বিস সাল বাদ – বিজয়ী
● ১৯৬৪: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড পলাতক – বিজয়ী
● ১৯৬৭: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড মণিহার – বিজয়ী
● ১৯৬৮: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড বালিকা বধূ – বিজয়ী
● ১৯৭৫: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড ফুলেশ্বরী – বিজয়ী
● ১৯৮৬: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড ভালোবাসা ভালোবসা – বিজয়ী
● ১৯৮৭: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড পথভোলা – বিজয়ী
● ১৯৮৮: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড আগমন – বিজয়ী
● ১৯৭২: বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড ধন্যি মেয়ে – বিজয়ী
● ১৯৭৫: বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড ফুলেশ্বরী – বিজয়ী
● ১৯৭৬: বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড প্রিয় বান্ধবী – বিজয়ী
● ১৯৮৫: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডি.লিট
● ১৯৮৬: সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার
● ১৯৮৯: মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
● ১৯৭১: প্রথম ভারতীয় গায়ক হিসেবে হলিউডের সিনেমায় নেপথ্য কন্ঠ দান ও আমেরিকা সরকার কর্তৃক বাল্টিমোর এর নাগরিকত্ব লাভ
● ২০১২: বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৈত্রী পুরস্কার (মরণোত্তর)
প্রথিতযশা গায়কের জীবনাবসান, Death of the renouned singer
খ্যাতনামা গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পূর্বে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এরপর থেকে বেশীরভাগ সময়ই তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ থাকতেন। কিন্তু শেষমেষ ১৯৮৯ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথিতযশা গায়কের জীবনাবসান ঘটে।
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
উপসংহার, Conclusion
বাংলা তথা হিন্দি ছবির সঙ্গীত জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বলাই বাহুল্য যে বাঙালিদের গান ও সংস্কৃতি তিনি নিজের গানের মাধ্যমেই ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সঙ্গীত জগতে রবীন্দ্র সঙ্গীত নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আকাশবানী রেডিওতে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, যা কবিগুরুর রচিত গানগুলোকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।
Frequently asked questions:
১৯২০ সালের ১৬ ই জুন।
পঙ্কজ মল্লিক।
বেলা মুখোপাধ্যায়।
১৯৮৯ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর।