” এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো। “
কবিগুরু এই কথাগুলি নতুন বছর তথা পহেলা বৈশাখ কে স্বাগত জানাতেই লিখেছিলেন। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালিদের মধ্যে চলে আসা এক বিশেষ পার্বণ হল বাংলা নববর্ষ।
এই পার্বণ জুড়ে রয়েছে বাংলা বর্ষবিদায় এবং নব বর্ষকে বরণের অনুষ্ঠানমালা। নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ হিসেবে পরিচিত, যা বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যবহুল একটি দিন। বাঙালিরা প্রতিবছরেই বর্ষ বরণ উৎসব অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালন করে।
নববর্ষ ও বাঙালি, New Year and Bengali
বাঙালিরা উৎসবমুখী তথা আনন্দপ্রিয় জাতি। পারিবারিক হোক, কিংবা সামাজিক অথবা রাষ্ট্রীয়, নানা উপলক্ষ্যে তারা মেতে ওঠেন আনন্দ উৎসবে। সেই সব উপলক্ষ্যের মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে আবির্ভূত হয় বাংলা নববর্ষ। কবিগুরুর ভাষায়-
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, Best essay on Education through mother tongue in Bengali
‘‘নব আনন্দে জাগো আজি নব রবির কিরণে, শুভ সুন্দর প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে।”
নববর্ষের আগমনে সমগ্র বাঙালিজাতি জেগে ওঠে নতুনের আহ্বানে। গ্রামেগঞ্জে থাকা জীর্ণ-কুটির থেকে শুরু করে বিলাসবহুল ভবন কিংবা শহরতলী- সর্বত্রই যেন প্রবাহিত হতে থাকে আনন্দের এক ফল্গুধারা। নববর্ষ এসে বিদায়ী বছরের সকল গ্লানি মুছে দিয়ে নতুনের কেতন ওড়ায় বাঙালির জীবনে, চেতনায় বাজিয়ে তোলে মহামিলনের সুর, যে সুরের মায়ায় সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বাঙালিরা এক সম্প্রীতির মোহনায় ভেসে যায়। তাই কবিগুরু লিখেছেন,
শিক্ষা বিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা, Know about Contribution of library in education in Bengali
“মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। “
এই দিনে বাঙালিরা নতুন পোশাক পরিধান করে, মন্দিরে যায়, সুস্বাদু খাবার রান্না করে এবং সকলে মিলে খাওয়া দাওয়া করে এবং প্রিয়জনের সাথে সময় কাটায়। নববর্ষ উপলক্ষ্যে একে অপরকে শুভ নববর্ষ শুভেচ্ছা জানানো হয়। এই আনন্দ উপলক্ষ উদযাপনের জন্য বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি মেলা এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
তবে নববর্ষ সকল বাঙালির কাছে কখনো একভাবে আসেনি। কারো কাছে এটি খরা হয়ে এসেছে, আবার কারো কাছে খাজনা দেওয়ার সময় হিসেবে এর আগমন, আবার কারোও বকেয়া আদায়ের হালখাতা হিসেবেও আসে এই পার্বণ, অন্যদিকে কারও কাছে মহাজনের সুদরূপে হাজির হয়, আবার কারো কাছে আসে আনন্দ উৎসব হিসেবে।
নববর্ষ পালনের ইতিহাস, Information about the history of New Year celebration
সৌর পঞ্জিকা অনুসারে অনেক কাল আগে থেকেই বাংলার বারো মাস পালন করা হত। সৌর বছরের প্রথম দিন বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, কেরল, মনিপুর, নেপাল, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, তামিল নাড়ুর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বহু বছর ধরেই পালিত হয়ে এসেছে। বর্তমানে নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালন করা হয়, বলতে গেলে এটি এক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, তবে আগেকার সময়ে এমনটি ছিল না।
পূর্বে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব বা ঋতুকালীন উৎসব হিসেবে পালন করা হত। তখনকার সময়ে নববর্ষ উৎযাপনের মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদেরকে ঋতুর উপর নির্ভর করেই চাষ করতে হত। নববর্ষে কৃষকেরা নতুন ফসল কাটে এবং নবান্ন গ্রহণ করেন, অনেক ক্ষেত্রে আশেপাশের বাড়ির সকলে মিলে একসাথে খাবারের আয়োজন করে, মেলায় ঘুরতে যায়, আরো বিভিন্ন ভাবে আনন্দ করে।
ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, Responsibilities and duties of student life in Bengali
নববর্ষের সাথে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের সম্পর্ক, The relationship of people’s economic life with the New Year
নববর্ষ কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক বা সামাজিক উৎসব হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়, এর পাশাপাশি তা অর্থনৈতিক উৎসবও বটে। বাংলা নববর্ষ আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের সাথেও নিবিড় তথা গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই সম্পর্কও তৈরি হয় হালখাতার মাধ্যমে। হালখাতা হল পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে পালিত এক বিশেষ উৎসব, যার মধ্যে চলে যাওয়া বছরের সমস্ত হিসাব-নিকাশ লিখে রাখার কাজ শেষ হয় এবং নতুন একটি খাতা খোলা হয়।
এই বিশেষ ব্যাপারটি বাঙালি ব্যবসায়ী, দোকানদার দ্বারা পালিত হয়। বেশিরভাগ দোকানে পয়লা বৈশাখের দিন লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করা হয় ও ভালো কিছু খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে হালখাতা পালন করা হয়। পুজোর পর নতুন খাতায় মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিক আঁকা হয়, তারপর নতুন খাতায় লেখা শুরু হয়।
চারধামের ভ্রমণ গাইড, Best details/travel guide about Char Dham in Bengali
নববর্ষ এবং ঐতিহ্যবাহী আনন্দধারা, Traditional entertainment and New Year
আগেকার সময়ে গ্রামেগঞ্জে পয়লা বৈশাখের দিন থেকে মেলা শুরু হতো এবং বেশ কিছুদিন চলতো, যেখানে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিয়ে দোকান সাজাতেন। বাচ্চাদের খেলার জিনিস, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের অলংকার, ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিস, ভিন্ন ধরনের প্রসাধনসামগ্রী, দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার করার মত বিভিন্ন জিনিসপত্রও পাওয়া যায়।
এছাড়াও মেলায় যাত্রাগান, পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা, ম্যাজিক শো ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের আসর বসে। অন্যদিকে নানা ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবারও পাওয়া যায় মেলায়। সাম্প্রতিককালে নববর্ষের সময় আয়োজিত মেলাগুলো কেবল গ্রামীণ জীবনেই সীমাবদ্ধ নেই, শহরতলিতেও এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়েছে। নববর্ষের দিনে এখন শহরেও বসে বৈশাখী মেলা।
তাছাড়া নববর্ষের বিশেষ দিন সকলেই নিজের বাড়িতে ভালো ভালো খারাব দাবারের আয়োজন করে থাকে, সাথে নতুন জামা কাপড় পরিধান করে। অনেক পরিবারের ক্ষেত্রে এই দিনের ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা-ইলিশ, আবার কেউ কেউ সর্ষে ইলিশও খায়, এসব ছাড়াও থাকে কচি লাউয়ের সাথে চিংড়ির তরকারি, এক কথায় মাছে মাংসে খাওয়া হয় সেদিন। এসবের কথা মনে পড়ে যায় এক গান,
” বাংলা কাতলা মাছের মুড়োয়
মুগের ভাজা ডাল
বাংলা পাবদা মাছ চেরা
কাঁচা লঙ্কার ঝাল “
শহরের জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ মানুষজন নিজের মতো করে নববর্ষ উৎযাপন করে নেয়, তাদের ব্যস্ত জীবন থেকে দুদিনের ছুটি পাওনা হয় বলে বছরের প্রথম দিন বাড়িতে সকলে মিলে একসাথে কাটানোর সুযোগটুকু পায়। ছোটবেলা থেকেই আমরা সকলে চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে এসেছি।
বাড়ির ছোটরা বড়দের প্রণাম জানায়, দূরে থাকা আত্মীয়দের সাথে টেলিফোনের মাধ্যমে শুভেচ্ছা আদান প্রদান করা, আবার এখনকার সময়ে তো মানুষ সামাজিক মাধ্যমেও শুভেচ্ছা জানায় একে অপরকে। বাড়ির সবাই মিলে দই মিষ্টি খাওয়া, গল্প ও গানের আসর ইত্যাদি করে সময় কাটান এবং দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেন।
পুরনো বছরের সকল ভুল, দুঃখ, মনখারাপ ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় এক নতুন আশার সাথে। কবির কথায়, “হে নূতন,দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। “
রাখীবন্ধন উৎসব নিয়ে যাবতীয় তথ্য, রাখি পূর্ণিমার শুভেচ্ছা, Raksha Bandhan wishes in bengali
আদিবাসীদের নববর্ষ উদযাপন, Adivasi New Year celebration
পার্বত্য আদিবাসীরা বাংলা নববর্ষকে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক তথা ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করে, তাদের মধ্যে এই উৎসব ‘বৈশাবি’ নামে পরিচিত। ফুরিয়ে যাওয়া বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন জুড়ে নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় এ উৎসবে।
উৎসব শুরুর দিন ‘গঙ্গাপূজা’ করা হয়, এবং বিভিন্ন রকম খাবার দাবার তৈরি করে সকলে মিলে একসাথে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের পহেলা বৈশাখ ‘বিজু উৎসব’ নামেও পরিচিত। বৈশাখের প্রথম দিনে মেয়েরা প্রচুর ফুল তুলে এনে ঘরের সাজসজ্জা করে। এই বিজু উৎসবের দিন গ্রামের আদিবাসী ছেলেমেয়েরা নতুন জামাকাপড় পরে এবং পাচন নামক একটি বিশেষ তরকারি রান্না করে যা অতিথি সহ উপস্থিত সবাইকেই খেতে দেওয়া হয়।
এই বিশেষ দিনে নানা ধরনের সবজি মিশ্রিত এই পাচন রান্না আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। তারা বিশ্বাস করেন যে, এই দিনে ভালো খাবার দিয়ে আহার করলে সারা বছর ধরেই ভালো খাওয়া দাওয়া করার সম্ভাবনা থাকে।
জেনে নিন দুর্গাপূজা নিয়ে অজানা সব তথ্য – Unknown Facts About Durga Puja in Bengali
বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপন, New Year celebration in Bangladesh
বাংলাদেশের মানুষ বর্ষবরণের দিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠে স্নান সেরে নিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে। আগের দিন বাড়িঘর পরিষ্কার করে সবকিছু সুন্দর করে সাজানো হয়, বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। অনেকে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। কিছু এলাকায় খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার।
মেলাতে অনেক দোকান বসে যেখানে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন থাকে, নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন করা হয়। তাছাড়া গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন এই বিশেষ দিনের এক পুরনো সংস্কৃতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা বা কুস্তি, একসময় এই সংস্কৃতি খুব প্রচলিত ছিল, তবে এখনো চট্টগ্রামে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে কুস্তির সবচেয়ে বড় আসর হয় ১২ বৈশাখ, যা জব্বারের বলি খেলা নামে খ্যাত।
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
উপসংহার, Conclusion
নববর্ষের সাথে বাঙালির আবেগ জড়িত। তাই বাঙালি প্রধান রাজ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে সকলে নিজের প্রিয়জনদের সাথে বছরের প্রথম দিন ভালোভাবে উপভোগ করতে পারে। মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মন থেকে পুরোনো বছরের সব গ্লানি, সকল একঘেয়েমি ভুলে গিয়ে সর্বজনীনভাবে নতুনের আনন্দে মেতে ওঠে সকলে। তাই কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়, ” ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ । ভাগিয়া মধ্যাহ্ন তন্দ্ৰা জাগি উঠি বাহিরির দ্বারে, চেয়ে বব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে। “