জিনতত্ত্ববিদ মাকসুদুল আলমের জীবনী, Biography of Bangladeshi scientist Maqsudul Alam in Bengali


মাকসুদুল আলম ছিলেন একজন বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ। তাঁর নেতৃত্বে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ডাটাসফট’ -এর একদল গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় সফলভাবে পাটের জিন নকশা উন্মোচিত হয় । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পাটের জিনোম অনুক্রম আবিষ্কার সম্পর্কে ঘোষণা দেন ।

জিনতত্ত্ববিদ মাকসুদুল আলমের জীবনী
Pin it

জন্ম ও শৈশব বৃত্তান্ত, Birth and childhood Memories of Maqsudul Alam

মাকসুদুল আলম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরে তাঁর জন্ম হয়। মাকসুদুলের পিতা দলিলউদ্দিন আহমেদ পেশায় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) একজন কর্মকর্তা এবং তাঁর মা লিরিয়ান আহমেদ ছিলেন একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষিকা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর পিতা শহীদ হন, অতঃপর পরিবারের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মা লিরিয়ান আহমেদের উপর এসে পড়ে। শিক্ষকতা কাজ করেই তিনি তাঁর চার ছেলে ও চার মেয়েকে লালন পালন করেছিলেন।

জন্ম ও শৈশব বৃত্তান্ত
Pin it

নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী, Biography of Raja Rammohan Roy in Bengali

মাকসুদুল আলমের শিক্ষাজীবন, Education 

মাকসুদুল আলম শৈশবকাল থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিজ্ঞান মনস্ক ছিলেন। একসময় মাকসুদুল আলম তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মাহবুবুল আলম এবং জোনায়েদ শফিক নামক এক বন্ধু সহযোগে গড়ে তোলেন ‘অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাব’। উক্ত ক্লাবের কাজ ছিল মূলত গাছ পর্যবেক্ষণ করা, বিভিন্ন গাছের চারা লাগানো এবং পাতা সংগ্রহ। সংগ্রহ করা ভিন্ন ভিন্ন গাছের পাতা অ্যালবামে সাজিয়ে গাছগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম বই দেখে দেখে বের করতেন তারা।

মাকসুদুল আলম গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাকসুদুল  রাশিয়ায় চলে যান। সেখানে মস্কোফস্কি গোসুদারস্তেভনেই উনিভারসিতিয়েৎ ইমিন্যে (মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন; ক্রমে একই বিশ্ববিদ্যাল থেকে ১৯৭৯ সালে স্নাতকোত্তর ও ১৯৮২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে বিখ্যাত মাক্স-প্লাংক ইনস্টিটুট ফর বিয়োখেমি (মাক্স প্লাংক জৈবরসায়ন ইনস্টিটিউট) থেকে ১৯৮৭ সালে প্রাণরসায়নে তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। 

মাকসুদুল আলমের শিক্ষাজীবন
Pin it

করুণাময়ী শ্রীশ্রী মা সারদার জন্ম বৃত্তান্ত ও জীবনী, Biography of Shri Shri Maa Saroda in Bangla

মাকসুদুল আলমের কর্মজীবন, Career of Maqsudul Alam

মাকসুদুল আলম প্রাণরসায়নের ডিটার উস্টাহেল্ট (Dieter Oesterhelt) এবং গেরাল্ড হেইজেলবাওয়াদের (Gerald Hazelbauer) সঙ্গে জার্মানিতে কাজ করার সুযোগ পান।  অতঃপর তিনি যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে “সামুদ্রিক জীবপণ্য প্রকৌশল কেন্দ্র” তে (Marine Bioproduct Engineering Center) সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৯২ সালে তাঁকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োজিত করা হয়। উক্ত কেন্দ্রে কাজ করার সময়কালে তিনি লবণ-আকর্ষী আর্কিয়ার ভৌত-তড়িৎ রূপান্তর (transduction) সংকেতকে বিশ্লেষণ করেন।

পরবর্তী সময়ে, ২০০০ সালে মাকসুদুল আলম ও তাঁর সহকর্মী র‌্যান্ডি লারসেন সহ আরো আটজন বিজ্ঞানী আর্কিয়াতে মায়োগ্লোবিনের মতো এক নতুন ধরনের আমিষ আবিষ্কার করেন এবং এই আমিষগুলোর নাম দেন গ্লোবিন-যুগল সংবেদক (globin-coupled sensors) এবং প্রোটোগ্লোবিন (protoglobins)। এছাড়াও ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীবপণ্য প্রকৌশল কেন্দ্রের উদ্যোগে পরিচালিত ‘অণুজীব বৈচিত্র‌্য অনুসন্ধান’ পর্বে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, লোঈহি (Lō‘ihi) নামক সমুদ্রগর্ভ আগ্নেয়গিরি ও নিউজিল্যান্ডের জলতাপীয় এলাকা পরিবীক্ষণ করে বেশ কিছু ভিন্ন প্রজাতির অণুজীব আবিষ্কার করেছিলেন তিনি।

মাকসুদুল আলমের কর্মজীবন
Pin it

২০০৩ সালে মাকসুদুল আলম হাওয়াই বিশ্বদ্যিালয়ে বংশাণুসমগ্র বিজ্ঞান, প্রোটিনসমগ্র বিজ্ঞান এবং জৈব তথ্যবিজ্ঞানে অগ্রসর গবেষণা কেন্দ্র (Advanced Studies in Genomics, Proteomics and Bioinformatics) প্রতিষ্ঠা করেন; যার ফলস্বরূপ হাওয়াইয়ান পেঁপের জিনোম অনুক্রম বের করা হয়। এই কাজ সম্পন্ন করার পর তিনি বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের প্রচ্ছদে স্থান পান। বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত পেঁপের জিন নকশা উন্মোচনের পর তিনি পাটের জিন নকশা উন্মোচন সম্বন্ধে ভেবেছিলেন; সে কারণে কয়েকবার বাংলাদেশে আসেন তিনি। এছাড়াও মালেয়শিয়ায় রাবার গাছের জিন নকশা উন্মোচনের কাজেও সফল হন তিনি।

এরপরে ২০০৯ সাল থেকে তিনি তোষা পাটের (Corchorus olitorius) জিন নকশা উন্মোচনের নেতৃত্ব দানে মনোনিবেশ করেন। উক্ত আবিষ্কারের সুফল হিসাবে মিহি আঁশের পাট, শীতকালীন পাট, সহজ-পচনশীল পাট, পোকা-প্রতিরোধী পাট, ঔষধী পাট, তুলার মতন শক্ত আঁশের পাট ইত্যাদি উদ্ভাবন করা সহজ হবে। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকমাক্রোফোমিনা ফেইজেওলিনার জিনোম অনুক্রম উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন তিনি।

সন্দীপ মাহেশ্বরীর জীবনী~একটি অনুপ্রেরণা, Sandeep Maheshwari biography in bengali

মাকসুদুল আলমের ব্যক্তিগত জীবন, Personal Life of Maqsudul Alam

মাকসুদুল আলম দু’বার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন। রাশিয়ায় থাকাকালীন তিনি ইরিনা আনাতোলিয়েভনাকে বিয়ে করেছিলেন।  মাকসুদুল তখন পিএইচডি ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত ছিলেন এবং ইরিনা ছিলেন একজন মেডিকেল পাঠরত ছাত্রী। এই দম্পতির লিলিয়ানা মাকসুদুলোভনা আলম (১৯৮৬-২০১৯) নামে একটি কন্যা সন্তান ছিল। ১৯৯২ সালে মাকসুদুল পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।  এর কিছু কাল পর, ১৯৯৭ সালে ইরিনার সাথে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়।  পরবর্তিতে ২০০৯ সালে তিনি রাফিয়া হাসিনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

গবেষণাসমূহ, Researches of Maqsudul Alam

মাকসুদুল আলমের একক বা যৌথভাবে তৈরি করা গবেষণারাজিগুলি হল:

● The draft genome of the transgenic tropical fruit tree papaya (Carica papaya Linnaeus) (বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিতকারিকা পাপায়া লিনিয়াস বা পেঁপের খসড়া বংশাণুসমগ্র)। নেচার, ২০০৮।

● Genome sequence of Halobacterium species NRC-1 (আলোবাকতেরিয়ুম গণের (এনআরসি-১) বংশাণুসমগ্রের অনুক্রম বিশ্লেষণ)। প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস অফ দ্য য়ুনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা, ২০০০।

গবেষণাসমূহ
Pin it

● Draft genome sequence of the rubber tree Hevea brasiliensis (রাবার গাছ এভিয়া ব্রাজিলিয়েনসিস এর খসড়া সম্পূর্ণ বংশাণুসমগ্র অনুক্রম নির্ণয়)। বিএমসি জেনোমিকস, ২০১৩।

● Isolation of novel bacteria, including a candidate division, from geothermal soils in New Zealand (নিউজিল্যান্ডের ভূতাপীয় মৃত্তিকা থেকে একটি প্রার্থী বিভাগ সহ নতুন ব্যাকটেরিয়া পৃথকীকরণ)। এনভায়রনমেন্টাল মাইক্রোবায়োলজি, ২০০৮।

● Tools to kill: Genome of one of the most destructive plant pathogenic fungi Macrophomina phaseolina (বধের হাতিয়ার:মাক্রোফোমিনা ফেইজেওলিনা নামক অন্যতম ধ্বংসী উদ্ভিদ রোগ সংক্রামকের বংশাণুসমগ্র বিশ্লেষণ)। বিএমসি জেনোমিকস, ২০১২ সাল।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবনী ~ Biography of Shirshendu Mukhopadhyay

প্রকাশনা, Publication 

মাকসুদুল আলমের জিনতত্ত্ব সম্পর্কিত গবেষণলব্ধ বিবৃতির অন্তর্ভুক্ত তথ্য পাঠ্য বইয়ের অধ্যায়ে যুক্ত করা হয়েছে:

●  Synteny and Collinearity in Plant Genomes (2008).

● Protoglobin and globin-coupled sensors (2008).

প্রকাশনা
Pin it

মাকসুদুল আলমের মৃত্যু, Death 

মাকসুদুল আলম যকৃতের সিরোসিস রোগে দীর্ঘমেয়াদে ভুগছিলেন। বেশ কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইনস মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অবশেষে ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই প্রথিতযশা জিনতত্ত্ববিদ। মাত্র ৬০ বছর বয়সে বাংলাদেশের সর্ব স্তরের বিজ্ঞানমনস্কদের অনুপ্রেরণা প্রদানকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের প্রানবিয়োগ ঘটে।

মাকসুদুল আলমের মৃত্যু
Pin it

স্বীকৃতি, Recognition

মাকসুদুল আলম কর্মক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। তিনি ২০০১ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এক্সিলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’,  ১৯৯৭ সালে এনআইএইচ ‘শ্যানন অ্যাওয়ার্ড’, ১৯৮৭ সালে ‘জার্মান সায়েন্স ফাউন্ডেশন’ থেকে হাম্বল্ট রিসার্চ ফেলোশিপ লাভ করেন। এছাড়াও স্নাতক ছাত্রদের শিক্ষাকে সমর্থন করার জন্য এবং মাকসুদুল আলমকে সম্মান জানাতে হাওয়াই ফাউন্ডেশন বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা “মাকসুদুল আলম গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড ফান্ড” তৈরি করা হয়েছিল।

স্বীকৃতি
Pin it

উপসংহার, Conclusion 

কৃষি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম বিভিন্ন গবেষণার কাজে সুদূর আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও নিজ দেশকে কখনোই ভুলে যাননি। নিজের অর্জিত জ্ঞান ও প্রতিভার প্রতিদানস্বরূপ তিনি তাঁর দেশের উন্নতির দিকেও নজর দিয়েছিলেন। মাকসুদুল আলমের এই মানসিকতা দেশের অন্যান্য উন্নয়নশীল গবেষকদের নিকট উদাহরণ হয়ে থাকবে। এই মহান বিজ্ঞানীর অবদান বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

কৃষি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম
Pin it

Frequently Asked Questions

মাকসুদুল আলম কে ছিলেন?

একজন বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ।

মাকসুদুল আলম কবে জন্ম গ্রহণ করেন?

১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর।

মাকসুদুল আলম কবে মৃত্যুবরণ করেন?

২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বরে।

মাকসুদুল আলম কত সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন?

২০১৬ সালে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক।


Recent Posts