যুগাবতার পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী, Biography of Shri Ramakrishna Paramahamsa in Bengali


 ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাতে আমাদের ধর্মবিশ্বাস, আচার -সংস্কৃতি, জ্ঞান সাধনা ও কর্মসাধনার  পথে এসেছিল অভাবনীয় রূপান্তর। বহুদিনের জড়তাগ্রস্ত সুপ্তি মগ্ন  সমাজ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে গতির আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। বাঙালির চিন্তায় ও মননের ক্ষেত্রে দেখা দিল অভূতপূর্ণ পরিবর্তন; এল ‘নবজাগরণ’ যাকে আমরা বলে থাকি ‘রেনেসাঁস’। কিন্তু জ্ঞানের শুষ্ক বালুকারাশিতে বাঙালির হৃদয় পরিতৃপ্ত হল না ,হৃদয় মনের শাসন মানল না। বাঙালির পিপাসার্ত হৃদয় এমন এক মহামানবের আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করছিল যিনি ভাবের বন্যায় বাঙালির মনোভূমিকে শ্যামল সরস করে তুলবেন; যার স্পর্শে লোহাও সোনায় রূপান্তরিত হবে; যিনি বহু মতের, বহু পথের সমন্বয় সাধন করে ধর্মের গণ্ডিকে মানবতার সুদূর জগতে প্রসারিত করে দেবেন -তিনি এলেন। তিনিই পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ।  

যুগাবতার পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী

শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব , Birth of Shri Ramakrishna Paramahamsa

“ওই মহামানব আসে 

দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে 

মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে  “

হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রাম ই সেই নব ভারতের তীর্থভূমি । ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে সেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নবযুগের আধ্যাত্মিকতার মূর্ত বিগ্রহ গদাধর। গদাধর শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্য নাম।শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় হল তার বিদ্যা রম্ভ কিন্তু সেই সীমাবদ্ধ কেতাবি বিদ্যা তাঁর বিশাল মানসভূমিকে বাঁধতে পারল না ।অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতি ই হল তার শিক্ষানিকেতন। শৈশব থেকেই তাঁর মেধা এবং উপলব্ধি শক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ।মূর্তি রচনা ,যাত্রা, গান, কথকতা ইত্যাদি র প্রতি তাঁর অস্বাভাবিক ঝোঁক ছিল এবং ভাব তন্ময়তা ছিল তাঁর আবাল্য প্রকৃতি।  শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিল ।একবার ধানক্ষেতের পথে চলতে চলতে আকাশে কালো মেঘের পটে সাদা বলাকা সারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন  ।

শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব

পরবর্তীকালে তিনি তাঁর সেই অদ্ভুত পরিণতিকে  ব্যাখ্যা করেছিলেন এক অপ্রকাশ্য   আনন্দের অভিজ্ঞতার রূপরেখা  হিসেবে  । বাল্যকালে আরও কয়েকবার তাঁর এরূপ ভাবতন্ময়তা পরিলক্ষিত হয়   – একবার দেবী বিশালাক্ষীর পূজার সময়, আরেকবার শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রায় শিবের চরিত্রাভিনয়কালে  গদাধর ভাব বিহ্বল হয়ে পড়েন  । দশ-বারো বছর বয়স থেকে তার এই ভাবতন্ময়তা দৈনন্দিন ঘটনা স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। রামায়ণ ,মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি পুরান ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় অনুরাগ। কিন্তু সর্বোপরি তাঁর জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রকাশ পেত এমন একটি সহজ অসাধারণত্ব, যা সকলকে বিস্মিত করেছিল এবং সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল ।

হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রাম

জয়া আহসানের জীবনকাহিনি | Biography of Jaya Ahsan in Bengali

শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্যকাল, Childhood of Shri Ramakrishna

বাল্যকালেই  ধর্মপ্রাণ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে, তাঁদের ধ্যানধারণার সঙ্গে গদাধর পরিচিত হয়েছিল। তাই ছোটবেলা থেকেই  মনের মধ্যে ছিল ধর্ম ভাবনার অমোঘ বীজ ,অনুকূল পারিপার্শ্বিকতায় তা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত, মুকুলিত হতে লাগল ।  বিদ্যায়তনিক লেখাপড়া গদাধরের হয়নি ।যিনি বিশ্বের অনাথ আতুর জনের জন্য মুক্তির বাণী বহন করে এনেছেন তাঁকে বিদ্যালয়ের গতানুগতিক শিক্ষার বেড়াজালে বাঁধা প্রকৃতপক্ষে  অসম্ভব। তিনি ধর্মের  অমৃত বাণী কণ্ঠে নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রবিষ্ট হন । তিনি গ্রামে গ্রামে যাত্রা -কথকতা করে দিন  কাটিয়েছেন শুনে তাঁর অগ্রজ, রামকুমার যাজকতার কার্যে সাহায্য করবার জন্য তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্যকাল

পূজা অর্চনা , Worship and rituals

কলকাতায় এসে গদাধরের পূজা অর্চনা ,স্তবপাঠ   ইত্যাদিতে দেখা দিল আশ্চর্য ভাব তন্ময়তা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও রামকুমার তাকে শাস্ত্র সম্মত যাজন ক্রিয়া শেখাতে পারলেন না । হৃদয়হীন শাস্ত্রীয়  পূজা অর্চনায় গদাধরের ছিল প্রবল অনীহা ।যে পূজায় হৃদয়ের স্পর্শ নেই, নেই অন্তরের সহজ স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাকুলতা সেই পূজার প্রতি গদাধরের কোনও দিনই সমর্থন ছিল না। সম্পূর্ণ মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন হয়েও কেবল ভাবাকুতির দ্বারা দেবতাকে বুকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় – গদাধর এতেই বিশ্বাসী ছিলেন ।

পূজা অর্চনা

সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মল্লিক এর জীবনকাহিনী ~ Biography of Pankaj Mullick in Bengali

ভবতারিণী দেবীর মন্দিরে পূজারির ভূমিকা, Shri Ramakrishna as a priest at Bhabatarini Mandir

ক্রমে গদাধর দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনী বিগ্রহের বেশকারীর পদে নিযুক্ত হলেন ।তখন থেকেই গদাধর ভাবতন্ময় হয়ে দেবীর সাজসজ্জায় আত্মনিয়োগ করতেন। দেবী  যে প্রস্তরময়ী, ভক্তি বিহ্বলতার প্রবল আবেগে সেটাও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন । পরে রামকুমারের মৃত্যুর পর গদাধর ভবতারিণী মন্দিরের পূজারি পদে নিযুক্ত  হয়েছিলেন। তাঁর ভক্তি আপ্লুত পূজা নিবেদনের অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। সেই সময়ে গভীর নিশিথে তিনি ধ্যানস্থ হতেন পঞ্চবটীর নিঃসঙ্গ নির্জনতায়।   মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম আঙিনায়  একটি ছোটো ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তাঁর বাকি জীবন। অনেকের মতে  রাণী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস, যিনি মথুরবাবু নামে ও বেশ প্রসিদ্ধ  ছিলেন, তিনিই গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন।তবে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন; তাদের মতে   এই নামটি তাঁর অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।

ভবতারিণী দেবীর মন্দিরে পূজারির ভূমিকা

ভাব বিহ্বলতা , Spiritual inclination

পুজোর প্রচলিত শাস্ত্রীয় রীতি  পরিত্যাগ করে গদাধর যখন ভক্তি ব্যাকুল কণ্ঠে  স্তবপাঠ করতেন কিংবা গান করতেন ,কিংবা “মা খাও”, “মা পর” বলে নৈবেদ্য থেকে অন্ন তুলে বিগ্রহের মুখের কাছে ধরতেন ,তখন অনেকেরই এই ধারণা হতো যে গদাধরের বুঝি মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। ক্রমে গদাধরের আর আনুষ্ঠানিক পূজা করবার ক্ষমতা রইল না ;তিনি মাতৃজ্ঞানে সর্বদা তন্ময় হয়ে থাকতেন এবং জীব জন্তু মাত্রকেই ‘মা’- ‘মা’ বলে  তাদের গলা জড়িয়ে ধরতেন। এভাবে তিনি সর্বভূতেই মাতৃদর্শন করতে লাগলেন।  সর্ব ক্ষেত্রেই বালকসুলভ আনুগত্য নিয়ে তিনি দেবীর নিকট প্রার্থনা নিবেদন করতে শুরু করেন। রাণী রাসমণি ও তাঁর জামাতা মথুরবাবু  শ্রীরামকৃষ্ণকে  স্নেহবশত  তাঁর ইচ্ছামতো পূজার অনুমতি দিয়েছিলেন।

ভাব বিহ্বলতা

লক্ষ্মীরতন শুক্লা – বাংলার গর্ব ~ Biography of Laxmi Ratan Shukla in Bengali

বিবাহ, Marriage

এর পরবর্তীকালে গদাধরের মা তাঁকে স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শ্রী শ্রী  সারদামণি সাথে তার বিবাহ দিলেন ।কিন্তু গদাধর পত্নীকে ও  মাতৃজ্ঞানে পূজা করতে লাগলেন। তার কিছুদিন পরেই গদাধর আবার দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসেন ।

বিবাহ

ভক্তি সাধনা ও বেদান্ত সাধনা , Bhakti worship and Vedic diksha

দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনী মন্দিরের গঙ্গা  সংলগ্ন চত্বরে বসে একদিন ভাবাবেগকে তন্ময় হয়ে তিনি  গান গাইছিলেন ,এমন সময় এক ভৈরবী সন্ন্যাসিনী তার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁর মধ্যে মহাভাবের দিব্য আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেন  এবং   স্বয়ং সমস্ত উপকরণাদির  আয়োজন করে দিয়ে ভক্তি সাধন মার্গে তাঁকে দিলেন পথনির্দেশ। তারপর এলেন পরম সাধক তোতাপুরি। তিনি গদাধরকে দিলেন বৈদিক সাধনায় দীক্ষা ।যে বেদান্ত সাধনায় মহাসাধক তোতাপুরির লেগেছিল সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর গদাধর সেই কঠিন সাধনা মাত্র একদিনেই আয়ত্ত্ব করে লাভ করলেন নির্বিকল্প সমাধি। তোতাপুরি বিস্মিত হলেন এবং কামারপুকুরের গদাধর হলেন বিশ্বের শ্রীরামকৃষ্ণ।

ভক্তি সাধনা ও বেদান্ত সাধনা

জওহরলাল নেহেরু – স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ~ Jawaharlal Nehru Biography in Bengali

শ্রীরামকৃষ্ণের অমৃত বাণী এবং মহাপ্রয়াণ , valuable sayings of Shri Ramakrishna and his final days

শ্রীরামকৃষ্ণের সিদ্ধিলাভের কথা দিকে দিকে প্রসারিত হয়ে গেল । চুম্বকের আকর্ষণে লৌহ খণ্ডের  মতন বহু পিপাসিত হৃদয় ছুটে এল দক্ষিণেশ্বরে। তিনি সকলকে পরম সান্ত্বনা দিয়ে বললেন “যত মত তত পথ”।সকল পথে গিয়ে পৌঁছেছে পরমেশ্বরের পদতলে ।অন্ধকারে অজ্ঞানে আবদ্ধ  মানুষ পেল আলোকের ঠিকানা; মুক্তি পথের নির্দেশ ।এলেন সিমলার দত্ত পরিবারের নরেন্দ্রনাথ । তিনি এই পরশমণির স্পর্শে হলেন জ্যোতির্ময় বিবেকানন্দ। তিনি সমগ্র বিশ্বে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী বহন করে নিয়ে গেলেন এবং শিব জ্ঞানে জীবসেবার গুরু নির্দেশকে মূর্ত করে তুললেন রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে । ২০০৮ সালে ভারত ও বহির্ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের মোট ১৬৬টি শাখাকেন্দ্র বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বেলুড় মঠে অবস্থিত।১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে জগতের সকল পাপ আকণ্ঠ ধারণ করে ক্যানসার রোগে শ্রীরামকৃষ্ণ করলেন মহাপ্রয়াণ ।  

শ্রীরামকৃষ্ণের অমৃত বাণী এবং মহাপ্রয়াণ

উপসংহার , Conclusion

শ্রীরামকৃষ্ণ বাঙালির ভক্তি সাধনায় এককথায় বাঙালির হৃদয়ের মূর্ত প্রতীক । খ্রিষ্টধর্মের প্রবল বন্যায় যখন হিন্দুধর্মের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, যখন ভাঙন ধরেছিল মানুষের ঈশ্বর  বিশ্বাসে, যখন অজ্ঞান তিমিরে পথের ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিল সমগ্র মানবজাতি তখনই শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিয়েছিলেন আলোকিত পথ। আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন হিন্দু সমাজকে। জীর্ণ   প্রাচীন সমাজে সঞ্চারিত করলেন নবজীবনের প্রাণোচ্ছ্বাস ।শ্রীরামকৃষ্ণ আজ সমগ্র বিশ্বের মুক্তি তীর্থ  ।

শ্রীরামকৃষ্ণ আজ সমগ্র বিশ্বের মুক্তি তীর্থ 

Frequently asked questions

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আসল নাম কী ?

গদাধর চট্টোপাধ্যায়

রামকৃষ্ণ কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ?

১৮ ই ফেব্রুয়ারি , ১৮৩৬ , হুগলির কামারপুকুরে।

রামকৃষ্ণ তাঁর পিতার কততম সন্তান ছিলেন?

চতুর্থ এবং শেষ সন্তান ।

রামকৃষ্ণ কলকাতায় আসেন কত খ্রিষ্টাব্দে?

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে  ।

গদাধর চট্টোপাধ্যায়কে রামকৃষ্ণ নাম দেন কে?

 রানি রাসমণির জামাতা মথুরবাবু   গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন।তবে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন; তাদের মতে   এই নামটি তাঁর অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।

কত বছর বয়সে রামকৃষ্ণের বিবাহ হয় ?

২৩ বছর বয়সে।

কে প্রথম ইংরেজিতে শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেন?

প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার  ।

Recent Posts