রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ জনগণের জীবনে থাকা সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, আশা, নিরাশা ইত্যাদি সকল রকম পরিস্থিতি তাঁর রচনায় গভীরতার সাথে ফুটে উঠেছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মপরিচয়ে নিজের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে বলেছিলেন যে , “সচেতনভাবে বাস্তববাদের আদর্শ গ্রহণ করে সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাহিত্য করিনি বটে , কিন্তু ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল।”
লেখক পরিচয়, Author introduction
মানিক বন্দোপাধ্যায় একজন সুখ্যাত ভারতীয় তথা বাঙালি কথাসাহিত্যিক, যার প্রকৃত নাম ছিল প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে চল্লিশটি উপন্যাস এবং তিনশত ছোটোগল্প রচনা করেন তিনি। তাঁর বেশ কিছু রচনা ইংরেজি সহ বহু বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনী, Best Biography of Hemant Mukherjee in Bengali
কথাসাহিত্যিকের জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিহার রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার অন্তর্গত দুমকায়। ১৯০৮ সালের ২৯ শে মে তাঁর জন্ম হয়। সাহিত্যিকের পিতার নাম ছিল হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন নীরদাসুন্দরী। ঢাকার বিক্রমপুর পরগণার মালপদিয়া গ্রামে তাদের পিতৃনিবাস ছিল। বিখ্যাত এই লেখকের পিতৃদত্ত নাম প্রবােধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে জন্মকালে তাঁর মুখশ্রী ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং গায়ের রঙ উজ্জ্বল কালাে ছিল। আঁতুরঘরে থাকাকালীন সময়ে থেকেই সকলে তাঁকে ‘ কালাে মানিক ’ বলে ডাকতে শুরু করে। পরবর্তীকালে এই নামেই তিনি খ্যাত হয়ে ওঠেন।
লেখকের শৈশবকাল, Childhood days of the author
সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পিতা হরিহর সরকারী অফিসে চাকুরীরত ছিলেন। কর্মসূত্রে বিভিন্ন সময়ে নানা স্থানে বদলি হতে হয়েছে তাঁকে , সেই সুবাদে বাংলা এবং বিহার অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে কেটেছে মানিকের বাল্যকাল।
সেই সময় থেকেই জীবনবােধ সম্পর্কে এক জাগ্রত চেতনা সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল লেখকের মনে, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর রচিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বিস্তার লাভ করেছিল; কারণ শৈশবকালে মানিক বন্দোপাধ্যায় নানা রকম পরিবেশ এবং ভিন্ন শ্রেণীর জনগণের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করার সুযােগ লাভ করেছিলেন।
যীশু খ্রীষ্ট জীবনী, Best biography of Jesus Christ in Bengali
শিক্ষাজীবনে মানিক বন্দোপাধ্যায়, Educational life
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন এবং পরবর্তীতে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে আই.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে অনার্স শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন। উক্ত কলেজে অধ্যয়ন করার সময়ই বিচিত্রা পত্রিকায় মানিক বন্দোপাধ্যায়ের রচিত প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ প্রকাশিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই সাহিত্যজগতে সাড়া পড়ে যায়।
সেই সময় তিনি কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং প্রথম গল্প হওয়ায় আত্মবিশ্বাসের অভাবও ছিল, তাই লেখক হিসেবে তিনি নিজের ডাকনামটি ব্যবহার করেছিলেন। সাহিত্যক্ষেত্রে পাওয়া খ্যাতিই লেখকের কলেজ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল। শেষ মেষ তাঁর আর বি.এস.সি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকের সাহিত্য জীবন, literary life of the author
প্রথম লেখা ছোটো গল্প প্রকাশ করে ভালোভাবে সাড়া পাওয়ায় পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সাহিত্যকেই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেন মানিক। গভীর মানবপ্রেমী তথা বাস্তববাদী উপন্যাসিক মানিক বন্দোপধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ছিল ‘দিবারাত্রির কাব্য’। সে সময়ে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে চলেছিল কল্লোল যুগ ।
কল্লোল পত্রিকার লেখকগােষ্ঠীর সঙ্গে মানিকও ভিড়ে গেলেন এবং শুরু হয়ে যায় তাঁর নিরন্তর সাহিত্য সাধনা। তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সমাজে বসবাসকারী সাধারণ জনগণের কথা, তাদের জীবনে সংঘটিত বিভিন্ন বিচিত্র ঘটনাগুলো আলেখ্য মরমী শিল্পীর মত চিত্রিত করেছিলেন ‘পদ্মানদীর মাঝি’ -তে। এটাই ছিল লেখকের এক নতুন জীবন দর্শন, তথা জীবনের নতুন এক দিগন্তের উন্মােচন। নিজের লেখার ধরনের মধ্য দিয়ে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন।
এ আর রহমান এর জীবনী, Best detailed biography of A.R. Rahman in Bengali
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কিছু উল্লেখযোগ্য রচনাবলী, Memorable works of Manik Bandopadhyay
স্বনামধন্য সাহিত্যিক যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন অবিরামভাবে লিখে গেছেন এবং রচনা করেছেন বহু গল্পগ্রন্থ, এমনকি তাঁর রচনায় রয়েছে একটি নাটকও। উল্লেখযােগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে —
● পরিস্থিতি (১৯৪৬)
● খতিয়ান (১৯৪৭)
● মাটির মাশুল (১৯৪৮)
● ছোট বড় (১৯৪৮)
● ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯)
● ফেরিওলা (১৯৫৩)
● লাজুকলতা (১৯৫৪)
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল —
● ‘ প্রাগৈতিহাসিক ’ ( ১৯৩৭ ) ,
● ‘ মিহি ও মােটা কাহিনী ‘ ( ১৯৩৮ ) ,
● ‘সরীসৃপ ‘ ( ১৯৩৯ ) ,
● ‘সমুদ্রের স্বাদ’ ( ১৯৪৭ ) ,
● ‘ আজ কাল পরশু ‘ ( ১৯৪৬ ) ,
● ‘ ছােট বকুলপুরের যাত্রি ’ ( ১৯৪৯ ) প্রভৃতি ।
সাহিত্যিকের রচিত নাটক হল –
● ভিটেমাটি (১৯৪৬)।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জীবনী, Best biography of Bill Clinton in Bengali
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস –
পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস , বহু গল্প ও কবিতা রচনা করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর উল্লেখযােগ্য উপন্যাস
● দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫)
● জননী (১৯৩৫)
● পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬)
● পদ্মানদীর মাঝি(১৯৩৬)
● জীবনের জটিলতা (১৯৩৬)
● অমৃতস্য পুত্রাঃ (১৯৩৮)
● শহরতলি (প্রথম খণ্ড) (১৯৪০)
● শহরতলি (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯৪১)
● অহিংসা (১৯৪১)
● ধরাবাঁধা জীবন (১৯৪১)
● চতুষ্কোণ (১৯৪২)
● প্রতিবিম্ব (১৯৪৩)
● দর্পণ (১৯৪৫)
● চিন্তামণি (১৯৪৬)
● শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬) প্রভৃতি ।
অর্থসংকটের সম্মুখীন, Financial crisis
মানিক বন্দোপাধ্যায় সাহিত্যিক হিসাবে জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এক সময় নানা কারণে অর্থকষ্ট সংক্রান্ত সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। অন্যদিকে একজন খাঁটি লেখক হবার প্রেরণা নিয়ে তিনি একটি সরকারি বড় চাকরির প্রলােভনও প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সুখ্যাত লেখকের জন্য সাহিত্যিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনী ~ Biography of Satyendra Nath Bose in Bengali
মার্কসবাদে বিশ্বাস, Author’s Belief in Marxism
সংগ্রামী জীবনের একজন সার্থক রূপকার মানিক বন্দোপাধ্যায়, তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন মার্কসবাদে। তাঁর সাহিত্য রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে এই প্রভাব অতি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিকাংশ রচনাতেই মার্কসবাদ ও ফ্রয়েডীয় মতবাদের দৃশ্যমান প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ এই মাকর্সবাদই লেখককে মধ্যবিত্ত সুলভ ভাব-প্রবণতার গন্ডি হতে উত্তরণ করার পথ নির্দেশ করে দিয়েছিল, ফলে তিনি প্রশস্ততর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি লাভ করেছিলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, এবং ১৯৪৫ সালে “ প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ ” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন, উক্ত সালে সংঘটিত ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন মানিক বন্দোপাধ্যায় এবং পরবর্তী সময়ে, ১৯৫৩ সালে প্রগতি লেখক এবং শিল্পী সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেন তিনি।
বৈবাহিক জীবন, Married life
মানিক বন্দোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালে সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা কমলা দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
জন এফ. কেনেডির জীবনী, Best Biography of John F. Kennedy in Bengali
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার অনূদিত গ্রন্থ, Translated books by Manik Banerjee
প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি উপন্যাস দেশীয় তথা বিদেশি ভাষার অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন সময় এই অনুবাদগুলো করেছিলেন। সেই সাহিত্যকর্মগুলো হল :
● দিবারাত্রির কাব্য : ইংরেজি অনূদিত গ্রন্থ “Poetry of the Day and Poetry of the Night”, অনুবাদক দীপেন্দু চক্রবর্তী।
● পুতুলনাচের ইতিকথা : হিন্দি, গুজরাটি, ওড়িয়া, মালায়ালম, তেলেগু, মারাঠি, সিন্ধি, অসমীয়া, ইংরেজি, হাঙ্গেরিয়ান প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
● পদ্মানদীর মাঝি : হিন্দি, গুজরাটি, ওড়িয়া, মালায়ালম, তেলেগু, মারাঠি, সুইডিশ, সিন্ধি, অসমীয়া, চিনা, জার্মান, ইংরেজি, হাঙ্গেরিয়ান প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রাণবিয়োগ, Death of the eminent author
দীর্ঘ সময় ধরে কঠিন রােগভােগ করার পর সংগ্রামী জনতার মুখপাত্র তথা কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটে। ১৯৫৬ খ্রিঃ ৩ রা ডিসেম্বর মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে লেখকের বিষয় ছিল মাত্র আটচল্লিশ বছর।
- ওপেনহেইমার এর জীবনী ও বিখ্যাত উক্তি সমূহ, Best Biography and quotes of Robert J Oppenheimer in Bengali
- ওয়াল্ট ডিজনির জীবনী, The Best Biography of Walt Disney in Bengali
- আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা, The best biography of Abdur Rahman in Bengali
- মৃণাল সেনের জীবনী, Best Biography of Mrinal Sen in Bengali
- টমাস আলভা এডিসন এর জীবনী, Best Biography of Thomas Alva Edison in Bengali
উপসংহার, Conclusion
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশ কিছু রচনা আমরা বিদ্যালয়ের পাঠ্য বইয়ে পড়েছি। তাঁর রচিত সাহিত্যে বস্তুবাদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মনুষ্যত্ব তথা মানবতাবাদের জয়গানই ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য। বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ হতদরিদ্র জনগণের জীবনচিত্রও তিনি নিজের বেশকিছু লেখায় তুলে ধরেছিলেন। তাই তাঁর লেখাগুলো খুব সহজেই মানুষের মন জয় করতে এবং কম সময়ের মধ্যে তাঁকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
Frequently asked questions
২৯ মে ১৯০৮
পিতা হরিহর বন্দোপাধ্যায় ও মাতা নিরাদাসুন্দরী ।
অতসী মামী ।
বাংলা ও বিহার অঞ্চলে ।
মেদিনীপুর ।
১৯৫৬ খ্রিঃ ৩ রা ডিসেম্বর ।