বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রবাদপ্রতিম এক ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শক্তিশালী সাহিত্য রচয়িতা তিনি। তারাশঙ্কর আঞ্চলিক জীবন ভাবনার এক সুনিপুন কারিগর ছিলেন।
আমৃত্যু সাহিত্য সাধনার কাজে নিজেকে নিবেদিত রেখে বাংলা সাহিত্যকে তিনি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সমর্থ হতে পেরেছিলেন। সাহিত্য জীবনে তিনি ৬০ টি উপন্যাস তথা ৩০০ এরও বেশি ছোট গল্প রচনা করেছেন। সাহিত্যিক ভুদেব চৌধুরী ‘বাংলা ছোট গল্পের মহাকবি’ হিসেবে তারাশঙ্করকে আখ্যায়িত করেছেন।
জন্ম ও পরিবার পরিচিতি, Birth and family
বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক তথা ছোট গল্পের একজন সার্থক রূপকার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয় ১৮৯৮ সালের ২৩ আগস্ট। তিনি বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন প্রভাবতী দেবী। তারাশঙ্কর ১৯০৫ সালে পিতাকে হারান। এরপর মায়ের কাছেই শৈশব কাটান। ছেলেবেলা থেকেই তারাশঙ্কর গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন তথ্য, Educational qualification
তারাশঙ্কর ১৯১৬ সালে জন্মস্থান লাভপুরের যাদবলাল এইচ. ই. বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে অধুনা আশুতোষ কলেজ অর্থাৎ বর্তমান সাউথ সাবআর্বান কলেজে ভর্তি হন। তবে ভগ্নস্বাস্থ্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার কারণে তাঁর লেখাপড়া শেষ করতে পারেন নি।
সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারাবাস, Tarashankar Banerjee’s imprisonment
১৯২১ সালে আই.এ. পড়ার সময়কালে তিনি ব্রিটিশ বিরােধী অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন। এর জন্য কারাবরণ পর্যন্ত করতে হয়েছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ১৯৩০ সালে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং এক বছর জেল খাটার পর ১৯৩১ সালে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন এবং সর্বক্ষণের সাহিত্য সাধক হিসেবে নিজেকে সাহিত্য জগতে নিয়োজিত করেছিলেন।
বারাক ওবামার জীবনী, Best Biography of Barack Obama in Bengali
কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী, Works of Tarashankar Banerjee
১৯৩৩ সালে তারাশঙ্কর ‘ ত্রিপত্র ’ নামক এক কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। মূলত কবিতা লেখার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর। কিন্তু কিছু সময় পর তিনি উপলব্ধি করেন যে কবিতা তাঁর ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি সার্থক মাধ্যম নয়, তারাশঙ্কর উপন্যাসের মাধ্যমে জনজীবনের নানা ধরনের টানাপােড়েনকে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
সেই থেকেই তিনি গদ্য সাহিত্যের চর্চা করতে শুরু করেন। তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘চৈতালী ঘূর্ণি’, যা ১৯৩২ সালে প্রকাশ পায়। তারপর ১৯৩৯ সালে ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে শরৎ – রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তারাশঙ্কর সাহিত্য কর্ম প্রকাশের ক্ষেত্রে ছদ্মনামের ব্যবহার করেছিলেন, সেই নামগুলি হল :হাবু শর্মা, কামন্দক।
বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে ৬৫ টি উপন্যাস, ১২ টি নাটক, ৪ টি আত্মজীবনী, ৫৩ টি গল্পগ্রন্থ, ৪ টি প্রবন্ধের বই, ১ টি কাব্যগ্রন্থ, ২ টি ভ্রমণ কাহিনী এবং ১ টি প্রহসন রয়েছে। তার লেখা বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে
● ‘ গণদেবতা ’ ,
● ‘ পঞ্চগ্রাম ‘ ,
● ‘ হাঁসুলিবাঁকের উপকথা ’ ,
● ‘ যােগভ্রষ্ট ’ ,
● ‘ ধাত্রী দেবতা ’ ,
● ‘ মন্বন্তর ’ ,
● ‘ আরােগ্য নিকেতন ’ ,
● ‘ বিচিত্রা ‘
ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে ছােটো গল্পের ক্ষেত্রেও একজন সার্থক রূপকার হিসাবে তারাশঙ্কর পাঠকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর রচিত রসকলি, ডাকহরকরা প্রভৃতি ছােটোগল্পগুলো পাঠকমহলে বহুল প্রচলিত। তাঁর লেখা বিখ্যাত কিছু নাটক হল পথের ডাক(১৯৪৩), দ্বীপান্তর (১৯৪৫), দুই পুরুষ (১৯৪৩), বিংশ শতাব্দী।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের জীবনী, Best Biography of President Joe Biden in Bengali
সাহিত্যিকের সাহিত্য রচনার ধরণ, Literary style
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার মধ্য দিয়ে রাঢ় বাংলার বিভিন্ন চিত্রকল্পের এক সার্থক রূপ পরিস্ফুটিত হয়েছিল। সাহিত্যিকের লেখায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাউরি, বাগদি, বোষ্টম, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের সম্পর্কে বিশেষ ভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। তারাশঙ্কর নিজের সব লেখাতেই ছোটো বড় সব মানুষের মহত্ত্বই ফুটিয়ে তুলেছিলেন, এটাই ছিল তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় গুণ।
তাছাড়াও তিনি নিজের লেখায় গ্রাম জীবনের ভাঙন এবং নগর জীবনের বিকাশের কথাও তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে পরাধীন জনগণের মনের গভীরে থাকা জ্বালা– যন্ত্রণাকে অনেক কাছে থেকে উপলব্ধি করেছেন তিনি। তাই তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে বারবার মনুষ্যত্বের অবমাননা তথা দেশভাগজনিত দুঃখ – জ্বালা – যন্ত্রণার বর্ণনা ফুটে উঠেছে।
দাঙ্গা হাঙ্গামা এবং নারীত্বের অবমূল্যায়নও তারাশঙ্করের লেখার উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। বাঙালির জীবনে ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটার সময় তথা রাজনৈতিক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে কীরূপ পরিবর্তন এসেছে সেই সব বিষয়ও তিনি নিজের লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য, Personal life
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন উমাশশী বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যিকের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পূর্বেই ১৩২২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে তাদের সংসারে পাঁচ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। দুই পুত্র সনৎ কুমার, সবিৎ কুমার, এবং তিন কন্যা গঙ্গা, সন্ধ্যা এবং বাণী।
কালজয়ী ঔপন্যাসিক তারাশঙ্করের পুরস্কার ও সম্মাননা সমূহ, Awards and honors of legendary novelist TaraShankar
কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে অসংখ্য পুরস্কার তথা সম্মান লাভ করেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরৎস্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার , জগত্তারিণী পুরস্কার , জ্ঞানপীঠ সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি পেয়েছিলেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তিনি পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বেশ কিছু গল্প উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয় এবং সেগুলো হাজার হাজার জনগণের মন জয় করেছিল। সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান রাখার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেলের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই বছর মৃত্যু হয় লেখকের তাই এই সম্মান থেকে বঞ্চিত থেকে যান তিনি।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং- এর জীবনী, Best Biography of scientist Stephen Hawking in Bengali
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়িত রূপ, Film adaptation of Tarashankar Banerjee’s story novel
সাহিত্য সংগঠক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত উপন্যাস, গল্প এবং নাটক -কে ভিত্তি করে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। সুবিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের লেখা জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসকে এক সফল চিত্ররূপ দিয়েছিলেন।
তারাশঙ্করের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি, Confusion over Tara Shankar’s name
সুবিখ্যাত ‘শ্রীময়ী’ উপন্যাসের জনক ছিলেন শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে উক্ত ব্যক্তি এই প্রতিবেদনে আলোচিত তারাশঙ্কর নন। সেজন্য একই নামেই দুই জন তারাশঙ্কর এর আবির্ভাব ঘটার ফলে সমস্যায় পড়েছিলেন ছােটো গল্পকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন তিনি এক নামকরা পত্রিকায় নিজ ছবি সহযোগে এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিলেন৷
সেখানে বলা হয় যে ” আমি আপনাদের পরিচিত শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে অপর একজন শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নামে লেখকের আবির্ভাব হয়েছে, ‘শ্রীময়ী’ তাঁহারই অমর সৃষ্টি। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে “শ্রী ময়ী ” গ্রন্থের লেখক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রী যুক্তই থাকুন, আমি নাহয় শ্রী হীন হইলাম।” সেই থেকে তিনি নিজের নাম থেকে শ্রী সম্বোধন বাদ দিয়ে দেন। এরপর থেকে সকলে তাঁর শ্রী- হীন নামযুক্ত স্বাক্ষর দেখেই বই কিনতে শুরু করেছিলেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু, Death
পরিণত বয়সে এসে ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলার খ্যাতনামা এই ঔপন্যাসিক তথা ছােটো গল্পকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়ান ঘটে।
- ওপেনহেইমার এর জীবনী ও বিখ্যাত উক্তি সমূহ, Best Biography and quotes of Robert J Oppenheimer in Bengali
- ওয়াল্ট ডিজনির জীবনী, The Best Biography of Walt Disney in Bengali
- আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা, The best biography of Abdur Rahman in Bengali
- মৃণাল সেনের জীবনী, Best Biography of Mrinal Sen in Bengali
- টমাস আলভা এডিসন এর জীবনী, Best Biography of Thomas Alva Edison in Bengali
উপসংহার, Conclusion
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্য জগতের এক স্তম্ভ বলা চলে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের সাথে সকলেরই পরিচিতি থাকা উচিত, কারণ তিনি ছিলেন একজন সমাজ সচেতক তথা সাহসী ব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে মানবতাবাদী চিন্তাধারার পরিস্ফুটন ঘটেছিল।
সেই সুবাদে তাঁর জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল আকাশচুম্বী। সাহিত্য সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি তারাশঙ্করের রচিত সাহিত্যসম্ভার সমূহ বিভিন্ন ভাষাতে অনুদিত হয়েছিল, তিনি শুধুমাত্র ঔপন্যাসিক তথা ছােটো গল্পকার হিসেবে চিহ্নিত নন, বরং তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সাহিত্য সংগঠক। তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালি সাহিত্যিকদের দৈনন্দিন জীবন বেশ কিছুকাল আবর্তিত হয়েছিল।
FAQ
১৮৯৮ সাল ৩রা আগস্ট।
কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার নাম ‘ত্রিপত্র’ ।
গণদেবতা ’ , ‘ পঞ্চগ্রাম ‘ , হাঁসুলিবাঁকের উপকথা ’ , ‘ যােগভ্রষ্ট ’ , ‘ ধাত্রী দেবতা ’ , ‘ মন্বন্তর ’ , ‘ আরােগ্য নিকেতন ’ , ‘ বিচিত্রা ইত্যাদি ।
১৯৩০ সালে ।
রবীন্দ্র পুরস্কার ও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ।
১৯৭১ সাল ১৪ সেপ্টেম্বর ।