” ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে, খাল বিল চৌচির, জল নেই পুকুরে। “
গ্রীষ্মকালের নাম শুনলেই হয়তো সবার আগে সূর্যের কঠোর তাপদাহ এবং প্রচন্ড গরমের কথাই সকলের মনে আসে। এতে যদিও ভুল কিছু নেই, কারণ গ্রীষ্মকাল মানেই রোদের কড়া তাপ, গরম বাতাসের প্রবাহ এবং চৌচির মাঠ। প্রতি বাংলা বছরের সূচনালগ্নে ঋতুরাজ বসন্ত বিদায় নেয় এবং আগমন ঘটে গ্রীষ্ম ঋতুর। কালের ক্রমে গ্রীষ্মকাল হলো বছরের প্রথম ঋতু। সুখময় বসন্ত শেষের দিকে এসে চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে কান পাতলে গ্রীষ্মের পদধ্বানি শোনা যায়। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাস জুড়ে পরিবেশে থাকে গ্রীষ্মকালের রাজত্ব।
গ্রীষ্মকালীন দুপুরে বিশেষ কিছু খাবার, Summer afternoon specials
গ্রীষ্মকাল বললেই পরিবেশের যে রূপ আমাদের সকলের মনে ভেসে ওঠে তা হল, নির্জন দুপুর, মাঠ জুড়ে খাঁ খাঁ করা রোদ্দুর, গ্রামের ফাঁকা রাস্তা ইত্যাদি। সকাল থেকেই মাথার ওপর থাকা জ্বলন্ত সূর্য যেন গ্রীষ্ম ঋতুর আগমনকে ঘোষণা করতে থাকে। তারপর সময় যতই এগিয়ে যায় এই ঋতুর কঠোরতা ততই তীব্র হতে থাকে। কবির ভাষায় বলতে গেলে-
“ মাঠে ঘাটে লোক নেই খাঁ খাঁ রোদ্দুর, পিপাসায় পথিকের ছাতি কাঁপে দুদ্দুর। ”
এমন দুপুরে একটু স্বস্তি পেতে অনেকেই বাড়িতে বসে টক জিনিস খেতে পছন্দ করেন। এইসময় কাঁচা আম গাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকে যা পেড়ে এনে পোঁড়া দিয়ে সরবত করে খাওয়া হয়, আবার কেউ কেউ কাঁচা আমের টক রান্না করেন, কেউবা পছন্দ করেন টক দই, আবার অনেকে তেঁতুল বা অন্য কোনো টক জাতীয় ফলের আচার খেয়ে আরাম পায়।
গ্রীষ্মের দুপুরে প্রকৃতির রূপ, Characteristic feature of summer afternoon
চৈত্র মাসের শেষদিক থেকে বসন্তের বাতাসে একটু একটু করে মিশে যেতে থাকে কঠোরতা, এরপর গ্রীষ্মের আগমনে বৈশাখ মাসের দুপুরে প্রকৃতির রূপ হয়ে ওঠে কঠিন তথা কঠোর। গ্রীষ্মের দুপুরে মধ্য গগনে বিরাজমান জলন্ত সূর্যদেব যেন নিজের সম্পূর্ণ তেজ উজাড় করে পৃথিবীর বুকে ঢেলে দেয়। ক্রমে ছোট ছোট খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয় ইত্যাদির জল শুকিয়ে যেতে শুরু করে, এর ফলে জলচর প্রাণীরা বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।
মাঠ, নদীচর, পথঘাট ইত্যাদি রোদের অসহ্য দাবদাহে ফুটিফাটা হয়ে ওঠে। সারা দুপুরবেলা ধরে বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বয়ে চলে তীব্র গরম বাতাস। সমগ্র প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় চারপাশকে প্রাণহীন মৃতপ্রায় বলে মনে হয়। প্রকৃতি যেন অসীম পিপাসায় একটু শান্তির বারিধারায় সিক্ত হওয়ার নিমিত্ত অপেক্ষা করে থাকে।
বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, Seasonal diversity of Bengal, Best details in Bengali
গ্রাম্য জীবনে গ্রীষ্মের দুপুর কেমন হয়, A summer afternoon in village life
ভারত প্রধানত গ্রাম নির্ভর সভ্যতা। সেই গ্রামগুলো গ্রীষ্মের খরতাপে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। গ্রামের যেসব মানুষ চূড়ান্ত প্রানবন্ততা নিয়ে নিজের কাজ করে যেত, ফসল ফলাত, ঢেঁকিতে ধান ভাঙতো, মাছ ধরতে যেতো, তাদের জীবন গ্রীষ্মের দুপুরের প্রখর দাবদাহে এবং রোদের করাল তাপে যেন ঝিমিয়ে পড়ে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলি ক্রমশ নুইয়ে আসে, তৃষ্ণার্ত পাখির দল তৃষ্ণার্ত হয়ে সামান্য জলের আশায় ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। সূর্যের তাপে ক্লান্ত শ্রান্ত পথিক গাছের শীতল ছায়ায় একটু শান্তি খুঁজে পায়। কবির কথা বলতে গেলে,
” জনশূন্য পলিপথে ধূলি উড়ে যায় মধ্যাহ্ন বাতাসে। স্নিগ্ধ অশথের ছায় ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিনী জীর্ণ বস্ত্র পাতি ঘুমায়ে পড়েছে। যেন রৌদ্রময়ী রাতি ঝাঁ ঝাঁ করে চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম।”
গ্রামের গৃহস্থরা খড়ের চালার মাটির ঘরে বসে, মাটির কলসে রাখা শীতল জল আর হাতপাখার মৃদু বাতাসে প্রশান্তি খুঁজে নেয়। কৃষকেরাও গ্রীষ্মের খরতপ্ত দুপুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও তাদের কাজে বিরাম থাকে না, দুপুরের প্রবল তাপে ঘামে সিক্ত হয়ে তারা ফসল চাষ করে চলেছে। কখনো দেখা যায় যে বিস্তৃত প্রান্তর বা ক্ষেতের মাঝে থাকা কোনও বৃহৎ বৃক্ষের শীতল ছায়ায় পরিশ্রান্ত কৃষক কাজ থেকে একটু বিরতি নিচ্ছেন। তবে গ্রীষ্মকালের দুপুরের এক অনিবার্য রূপ হল কালবৈশাখী।
গ্রীষ্মের অসহ্য গরমে ভূপৃষ্ঠ যখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, তথা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তখন প্রকৃতির আশীর্বাদের মত আকাশ কালো করে ঘনিয়ে আসে এক মেঘের চাদর, যার সাথে বয়ে আসে শীতল ঝড়ো হাওয়া, প্রকৃতির অঞ্জলি রূপে ধরিত্রীর বুকে নেমে আসে শীতল বারিধারা। কবির ভাষায় বলতে হয়,
” রূপকথার চাদরে মোড়া মেঘগুলোর হঠাৎ আগমন, কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়া, মালতী লতার সুবেশ সুগন্ধ, এসেছে গ্রীষ্ম এসেছে প্রখর তাপের রানি এসেছে। “
রঙিন বসন্তের বর্ণময় উক্তি | Beautiful Bengali Quotes, Posts about Spring Season
শহরাঞ্চলগুলোতে গ্রীষ্মের দুপুর কেমন হয়, Summer afternoon in city life
গ্রামাঞ্চলের তুলনায় দেখতে গেলে শহরাঞ্চলেই গ্রীষ্মের দুপুরগুলোর নিজের রুদ্র রূপের কঠোরতা বেশি প্রদর্শন করে। শহরের কর্মকোলাহলময় যান্ত্রিক বাস্তবতায় গ্রীষ্মের দুপুর বলতে গেলে উপেক্ষিতই হয়। এর মূল কারণ হলো গ্রামের চাইতে শহরে বৃক্ষরাজির অপ্রতুলতা থাকে, যথেষ্ট পরিমাণ জলাভূমির অভাব থাকে, তাছাড়া রয়েছে কলকারখানার প্রাচুর্য ও ক্রমবর্ধমান দূষণ।
এই সব কারণেই শহরাঞ্চলে গ্রীষ্মের দুপুর আরো অসহ্যকর হয়। যদিও শহরের আধুনিক সভ্যতা গ্রীষ্মের কঠোরতা থেকে মুক্তি পেতে বেশ কিছু কৃত্তিম উপায় ব্যবহার করে থাকে। কর্মব্যস্ত মানুষ উত্তপ্ত দুপুরের ত্রাস থেকে মুক্তি পেতে ঠান্ডা শরবত দ্বারা গলা ভেজায়। তাছাড়া অনেকেই অফিস কিংবা বাড়িতে ফ্যান বা কৃত্রিম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে থেকে স্বস্তি খুঁজে নিতে চেষ্টা করে।
তবে শহরে থাকা মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রমজীবী জনগণের দুর্দশার অন্ত থাকে না। জীবন যাপনের তাগিদে বাধ্য হয়েই তাদেরকে কাজে নামতে হয়। প্রখর রোদে ঠেলাওয়ালা ও রিকশাওয়ালাদের কষ্টের কোনো সীমা থাকে না, তার উপর শহরের বুকে তো গাছের ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার মতও কোনো উপায় নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেওয়া হয় ফলে বেশ কিছু দিনের জন্য ছাত্রছাত্রীদের রোদে পুড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেতে হয় না।
তবে এটা অস্বীকার করার নয় হে, রোদ যতই প্রখর রূপ ধারণ করুক না কেন, শহরের জীবনযাত্রাকে কখনই স্তব্ধ করে দিতে পারে না; বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ জুড়ে গ্রীষ্মের দুপুরের রুদ্রনৃত্যও শহরাঞ্চলের আধুনিকতার চাকাকে আটকে দিতে সক্ষম নয়।
শীতকাল নিয়ে উক্তি, স্টেটাস, ফটো সমূহ ~ Bengali Quotes, Lines, Shayeri & SMS on Winter Season
গ্রীষ্মের দুপুর এবং কর্মজীবনের সম্পর্ক, Summer afternoons and work pattern
সমাজের বিস্তৃত কর্মজগতের সাথে জড়িত মানব জীবনও গ্রীষ্মের দুপুরের ব্যাপক তাপে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের রুদ্রমূর্তিতে বিহ্বল হয়ে পড়ে তারা। প্রচণ্ড গরমের কারণে তাদের শরীর ক্রমশ শুষ্ক ও তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের ও শহরের গৃহবধূরা নিজের ঘরের সব কাজ সেরে নিয়ে, ক্লান্ত শরীরে পাখার নিচে এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম করেন। অফিস কাছারির সাথে নিয়োজিত মানুষ গ্রীষ্মের খরতপ্ত মধ্যাহ্নেও অবিরাম কাজে ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মের ছুটি থাকায় শিক্ষক-শিক্ষিকারা এবং ছাত্রছাত্রীরা নিজের পরিবারের সাথে কোন মনোরম স্থানে ছুটিও কাটিয়ে থাকেন।
সবার শিক্ষা সর্বশিক্ষা অভিযান, Know about Education for all campaign in Bengali
গ্রীষ্মের দুপুরে বাংলার চিরাচরিত সংস্কৃতি, Summer afternoons and Bengali culture
গ্রীষ্মের দুপুরের রূপ যতই কঠোর ও কঠিন হোক না কেন, তা সরাসরি বাংলার সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে বাংলার গ্রামাঞ্চলে। গ্রীষ্মের দুপুরে ক্লান্ত পথিকেরা গাছের ছায়ায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আবার একসাথে বেশ কয়েকজন সমাগমে আড্ডা জমে ওঠে, এইভাবেই নতুন পরিচিতি তৈরি হয়, মানুষে-মানুষে গড়ে ওঠে সামাজিক বন্ধন। গ্রীষ্মের গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে গ্রামাঞ্চলে পান্তা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
গ্রীষ্মের দুপুরে গৃহবধূরা রোদে বড়ি শুকাতে দেয়, আচার তৈরি করে, আমসত্ত্ব শুকোতে দেয়, ইত্যাদি বাংলার সুমধুর গ্রামীণ সংস্কৃতিগুলি পালন করে। দুপুরের অবসর সময় কাটাতে গ্রামের ঘরে ঘরে মেয়েরা ও গৃহবধূরা মিলে কাপড়ের উপর নানা রকমের নকশা সেলাই করে, আবার বেশ কিছু গ্রামীণ উপজাতি আছে যারা নিজের ঘরের দেওয়ালে, মাটির খুরির উপর, অথবা কাপড়ের গায়ে ফুটিয়ে তোলে নানা ধরনের চিত্রকলা। অন্যদিকে শহরাঞ্চলের মানুষ তাদের অতি ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে উত্তপ্ত গ্রীষ্মের দুপুরে দু’দণ্ড স্বস্তি খুঁজে নিতে ভিড় জমায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন শপিং মল, অথবা সিনেমা হলগুলোতে।
- জীবন গঠন এবং চরিত্র সেরা রচনা, Best essay on Development of life and character in Bengali
- বাংলাদেশের যানজট সমস্যা, Traffic congestion problem of Bangladesh best article in Bengali
- ইভটিজিং সম্পর্কে বিস্তারিত, Best details about Eve teasing in Bengali
- সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম, Best write-up on Cyber crime in Bengali
- অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সেরা রচনা, Importance of perseverance best essay in Bengali
উপসংহার, Conclusion
গ্রীষ্মকালের দুপুরগুলো আমাদের সকলের সম্মুখে পৃথিবীর এক বিচিত্র রূপ তুলে ধরে। এই দুপুরের মধ্যে জলন্ত সূর্যের খরতপ্ত রুদ্র রূপ বর্তমান থাকলেও, গ্রীষ্মের দুপুরের নিজস্ব এক প্রাণময় চরিত্র রয়েছে। গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ এবং শুষ্ক হয়ে ওঠে। গ্রীষ্ম যখন নিজের রুদ্রমূর্তি নিয়ে প্রকৃতিতে ধরা দেয়, তখন শ্যামল প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্য্য হারিয়ে যেতে থাকে। বলতে গেলে গ্রীষ্মের দুপুর রুক্ষতা ও বিবর্ণতার এক বিরূপ ভাব নিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ধরিত্রীকে শাসন করতে থাকে।