ঝাঁসীর রাণী বা “ঝাঁসী কি রানী” লক্ষ্মীবাঈ আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের অন্যতম পথিকৃৎ ও প্রতিমূর্তি হলেন এই রানী লক্ষ্মীবাঈ ।
ঝাঁসির রানীর জন্ম ও শৈশব জীবনের বিবরণ, Details of birth and childhood life
লক্ষ্মীবাঈ ১৮৩৫ সালের ১৯ নভেম্বর বেনারসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহারাষ্ট্রের এক মারাঠী করাডে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম মরুপান্ত তাম্বে, যিনি বিথুরে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের দরবারে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ভাগীরথী বাঈ তাম্বে। জন্মের পর রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম রাখা হয়েছিল মণিকর্ণিকা তাম্বে এবং বাড়ির আদুরে নাম ছিল মনু। মনু কে তাঁর বাবা আবার ‘ছাবিলি’ নামেও ডাকতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে মাত্র চার বছর বয়সেই ছোট্ট মনু মাতৃহারা হয়। পরে তাঁর পিতা তার লালন পালন করেছিলেন।
শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আল-মুতীর জীবনী, Biography of Abdullah-Al-Muti in Bengali
লক্ষ্মীবাঈ’য়ের শিক্ষা জীবনের ইতিহাস, Education of Lakshmi Bai
পিতা মরুপান্ত তাম্বে কোর্টের কাজ-কর্মে জড়িত থাকার কারণে মনু ঐ সময়কর অন্যান্য নারীদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সময় আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া চালনার শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও মনু নিজের বান্ধবীদেরকে নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়৷ তিনি পড়তে এবং লিখতে সক্ষম ছিলেন। নিজের সমসাময়িক নারীদের তুলনায় তিনি অনেকটাই বেশি স্বাধীন মনোভাবের অধিকারী এবং দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি বাল্যকাল থেকেই নানাসাহেব ও তাঁতিয়া টোপির কাছে তলোয়ার চালানো এবং তীরন্দাজি বা আর্চারী ইত্যাদি শিখে নিয়েছিলেন৷
নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ: ডা. নাসিমা আক্তারের জীবনী, Biography of Dr. Nasima Akter in Bengali
মণিকর্ণিকার বিবাহ, Marriage of Manikarnika
ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও নেওয়ালকারের সঙ্গে ১৮৪২ সালে মণিকর্ণিকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ঝাঁসিতে চলে যাওয়ার পর সেখানে তাঁর নতুন নামকরণ করা হয়, নাম দেওয়া হয় লক্ষ্মীবাঈ। রাজা গঙ্গাধরের আগেও একজন স্ত্রী ছিলেন যিনি নিঃসন্তান অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৮৫১ সালে রানী লক্ষ্মীবাঈ এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, তার নাম রাখা হয়েছিল দামোদর রাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের সেই সন্তানটি মাত্র চার মাস বেঁচেছিল। এদিকে রাজা গঙ্গাধরেরও বয়স বেড়ে যাচ্ছিল, তাই রাজা রানী মিলে তাঁদের এক আত্মীয়ের সন্তানকেই দত্তক হিসেবে নিয়ে নেন, এবং তাঁর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখেন দামোদর রাও।
রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর প্রভাব, Consequence of Raja Gangadhar Rao’s death
১৮৫৩ সালে রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের প্রাণ বিয়োগ ঘটে, এই সুযোগ কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে তৎকালীন জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঝাঁসিতে ‘স্বত্ত্ববিলোপ নীতি’ প্রয়োগ করে৷ এই নীতি অনু্যায়ী, কোনো একটি রাজ্যের রাজা যদি তাঁর নিজের রক্তের সম্পর্কের কাউকে উত্তরাধিকারী হিসেবে না রেখে যায়, তবে সেই রাজ্যটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে৷ তখন রানী লক্ষ্মীবাঈ এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান৷
তিনি কোনোভাবেই ঝাঁসিকে ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করার পক্ষপাতি ছিলেন না। ১৮৫৪ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈকে বাৎসরিক ৬০০০০ টাকার চুক্তিতে রাজপ্রাসাদ এবং দুর্গ ছেড়ে দেওয়ার এক শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্মীবাই এর বিরোধিতা করেন।
যুগাবতার পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী, Biography of Shri Ramakrishna Paramahamsa in Bengali
মহাবিদ্রোহে লক্ষ্মীবাই এর ভূমিকা, Lakshmibai’s role in the Great Revolt of 1857
১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর তার আঁচ ঝাঁসিতেও এসেছিল৷ বিদ্রোহীরা ক্ষোভে ষাট জন ইংরেজকে হত্যা করেছিল। রানী লক্ষ্মীবাই তখন নিজের প্রাসাদে ছিলেন। যদিও লক্ষ্মীবাঈ এই হত্যাকাণ্ডের সাথে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না, কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে ব্রিটিশ সরকার সিপাহী বিদ্রোহকে শক্ত হাতে দমন করার সাথে সাথে ঝাঁসির বিদ্রোহীদের কঠোর সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ তৎকালীন জেনারেল হিউজ রস তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ১৮৫৮ সালে ঝাঁসি রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন, তখন রানী লক্ষ্মীবাঈ তাঁর বাহিনী নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
ঝাঁসি রাজ্যের হয়েই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নেতা তাঁতিয়া টোপিও ২০ হাজার সৈন্য সমন্বিত একটি দলের নেতৃত্ব দেন, যদিও শেষ অবধি তারা প্রশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ সেই ব্রিটিশ সৈন্যদের অবরোধ ভাঙতে পারেননি। রানী লক্ষ্মীবাঈ অবশেষে হার স্বীকার করতে বাধ্য হন। ইংরেজ বাহিনী ঝাঁসিতে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করার পূর্বেই লক্ষ্মীবাঈ পুত্র সহ রাজ্য ছেড়ে কাল্পিতে পালিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে তাঁতিয়া টোপির নেতৃত্বে তিনি একটি বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দেন৷
এর কিছু সময়ের মধ্যেই সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল৷ অন্যদিকে প্রস্তুতি নিয়ে লক্ষ্মীবাঈ এবং তাঁতিয়া টোপি গোয়ালিয়রের দিকে রওনা হয়ে পড়েন। তাঁদের যৌথবাহিনী মিলে গোয়ালিয়রের মহারাজার দলকে পরাজিত করে দেয় এবং কৌশলগত অবস্থানে থাকা গোয়ালিয়রের কেল্লা দখল করে নেয়।
১৮৫৮ সালের ১৭ জুন, ফুল বাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে পূর্ণোদ্দম্যে রাজকীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত শহীদ হন রাণী লক্ষ্মীবাঈ। পরবর্তীতে আরও তিনদিন লড়াই করার পর ব্রিটিশ সেনাদল গোয়ালিয়র পুণর্দখল করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ শেষ হবার পর, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জেনারেল হিউজ রোজই নিজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করতেন যে,
“রাণী তার সহজাত সৌন্দর্য্য, চতুরতা এবং অসাধারণ অধ্যবসায়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও, তিনি বিদ্রোহী সকল নেতা-নেত্রীর তুলনায় সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিলেন।”
জিনতত্ত্ববিদ মাকসুদুল আলমের জীবনী, Biography of Bangladeshi scientist Maqsudul Alam in Bengali
বীরাঙ্গনার স্মৃতি ও সম্মাননা, Heroic memory and honor
পুত্রকে পিঠে বেঁধে রাখা অবস্থায় ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের মূর্তিগুলি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পরিলক্ষিত হয়। গোয়ালিয়রে এই বীরাঙ্গনার নামে ‘লক্ষ্মীবাঈ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন’ গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া তিরুবনন্তপুরমেও ‘লক্ষ্মীবাঈ ন্যাশনাল কলেজ অফ ফিজিক্যাল এডুকেশন’ স্থাপন করা হয়েছে৷ ঝাঁসিতে তাঁর নামে এক মেডিকেল কলেজের নামকরণও করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ‘রানী লক্ষ্মীবাঈ কেন্দ্রীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ‘রানী ঝাঁসি মেরিন ন্যাশনাল পার্ক’ টি অবস্থিত। মহাবিদ্রোহের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৭ সালে বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী বাঈ এর নামে দুটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল। বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস, কবিতা এবং চলচ্চিত্রে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে নিবেদিত একজন বীর ব্যক্তি হিসাবে রানী লক্ষ্মীবাঈ এর নাম উল্লেখ করা হয়। স্বনামধন্য লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী রানী লক্ষ্মীবাঈ এর বীরত্ব নিয়ে “ঝাঁসী কি রাণী” নামে একটি বই লিখেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন সাগরী এবং মন্দিরা সেনগুপ্তা। সুখ্যাত লেখিকা সুভদ্রা কুমারী চৌহানের লেখা ” ঝাঁসি কি রানী” কবিতাটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ছোটোদেরকে পড়ানো হয়৷ উক্ত কবিতার বিখ্যাত পঙক্তিটি হল “খুব লড়ি মর্দানি, ওহ্ তো ঝাঁসি ওয়ালি রানী থি “।
বিশিষ্ট ধর্ম সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেনের জীবনী, Biography of Keshab Chandra Sen in Bengali
ঝাঁসির রানীর চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ধারাবাহিক, Rani of Jhansi films and television series
লক্ষ্মী বাঈ কে নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও সিরিজ পরিচালনা করা হয়েছে। সেগুলি হল :
● দ্য টাইগার এণ্ড দ্য ফ্লেম, ১৯৫৩ সালে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম টেকনিকালার চলচ্চিত্রের একটি। ছবিটির পরিচালক ও নির্দেশক ছিলেন চলচ্চিত্রকার সোহরাব মোদী। এই চলচ্চিত্রটি ঝাঁসির রানী চরিত্রকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।
● “ঝাঁসী কি রাণী” নামে একটি হিন্দি টেলিভিশন সিরিজ পরিচালনা করা হয়েছিল।
● ২০১৮ সালে রাধা কৃষ্ণ ও জগরলামুদি “মণিকর্ণিকাঃ দ্যা কুইন অফ ঝাঁসি” নামক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যেখানে মনিকর্নিকার চরিত্রে ছিলেন কঙ্গনা রানাওয়াত।
- ওপেনহেইমার এর জীবনী ও বিখ্যাত উক্তি সমূহ, Best Biography and quotes of Robert J Oppenheimer in Bengali
- ওয়াল্ট ডিজনির জীবনী, The Best Biography of Walt Disney in Bengali
- আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা, The best biography of Abdur Rahman in Bengali
- মৃণাল সেনের জীবনী, Best Biography of Mrinal Sen in Bengali
- টমাস আলভা এডিসন এর জীবনী, Best Biography of Thomas Alva Edison in Bengali
উপসংহার, Conclusion
ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ আজও আমাদের ভারতবর্ষের ‘জাতীয় বীরাঙ্গনা’ হিসেবে পরিচিত। তাঁকে সর্বদাই ভারতীয় রমণীদের সাহসী প্রতীক ও প্রতিকল্প হিসেবে চিত্রিত করা হয়। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু’র নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্তর্গত প্রথম নারী দলের নামকরণও রাণী লক্ষ্মী বাঈ এর স্মরণে করা হয়েছিল।
Frequently Asked Questions
লক্ষ্মী বাঈ কে?
“ঝাঁসী কি রানী” লক্ষ্মীবাঈ আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব।
লক্ষ্মী বাঈ কিভাবে ঝাঁসির রানী হয়েছিলেন?
ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও নেওয়ালকারের সাথে বিবাহ হওয়ার পর।
লক্ষ্মী বাঈ নামকরণ কিভাবে হয়?
বিবাহের পর তাঁর নাম মনিকর্নিকা থেকে লক্ষ্মী বাঈ রাখা হয়েছিল।
লক্ষ্মী বাঈ কবে শহীদ হন?
১৮৫৮ সালের ১৭ জুন।