“বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।”
– সৈয়দ মুজতবা আলীর এই চিরন্তন বাণী যুগে যুগে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এসেছে।
সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বিংশ শতকের একজন স্বনামধন্য বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার, এছাড়াও অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা হিসেবেও বিশেষ পরিচিত লাভ করেছেন তিনি । তিনি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন তাঁর রচিত ভ্রমণকাহিনিগুলির মাধ্যমে। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাসমূহ একই সঙ্গে ছিল পাণ্ডিত্য তথা রম্যবোধে পরিপুষ্ট।
জন্ম ও শৈশব স্মৃতি, Early life and childhood
সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর। তিনি তৎকালীন অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। এই শ্রীহট্ট জেলা বর্তমানে সিলেট নামে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। লেখকের পৈতৃক ভিটা ছিল মৌলভীবাজার, পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার উত্তরসূর গ্রামে। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী পেশাগতভাবে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী পিতামাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তিনজন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
সুপারস্টার দেব এর জীবনকাহিনী ~ Biography of Bengali Superstar Dev aka Deepak Adhikari
শিক্ষা অর্জন, education
পিতার বদলির চাকরি হওয়ার সবাদে মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তিনি সিলেটের সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি অবধি পড়াশুনা করেন। পরে ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছাত্র ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দূ, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ প্রায় পনেরোটি ভাষাশিক্ষা লাভ করেন এবং ১৯২৬ সালে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার উদ্দেশ্যে বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণা করে ১৯৩২ সালে তিনি ডি.ফিল ডিগ্রি লাভ করেন । পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী এবং অত্যন্ত মেধাবী সৈয়দ মুস্তাফা আলী ১৯৩৪-১৯৩৫ সালে মিশরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ধর্মশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন।
কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাসমূহ, Career experiences
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে মুজতবা আলী ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল অবধি কাবুলের এক কৃষি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষা দপ্তরে অধ্যাপনার কাজ করেন। সেখানে তিনি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার শিক্ষক তথা শিক্ষা দপ্তরের একজন অধিকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৫ সালে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। উক্ত কলেজে তিনি আট বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর মুজতবা আলী দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। সেখানে কিছুকাল কাজ করার পর দেশভাগের প্রাক্কালে তিনি ফিরে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পুনরায় কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মুজতবা আলী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগেও খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছু সময়ের জন্য পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের পদে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে কর্মজীবনের সায়াহ্নে ১৯৬১ সালে তিনি তাঁর প্রিয় স্থান শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৬৫ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।
নৃত্যগুরু উদয় শঙ্করের জীবনকাহিনী – Uday Shankar Biography in Bengali
বাংলা সাহিত্যে মুজতবা আলীর অবদান, Linguistic abilities and contribution of Syed Mujtaba Ali
শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালে সেখানকার বিশ্বভারতী নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী নিয়মিত লিখতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনাম ব্যবহার করে দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতে শুরু করেন। তাঁর বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ভ্রমণলিপি লিখেছেন।
এছাড়াও লিখেছিলেন ছোটগল্প, উপন্যাস তথা রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক এবং রূপকের যথার্থ ব্যবহার করার দক্ষতা, হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষেত্রে পারদর্শিতা এবং লেখার মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা মুজতবা আলীকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছে। অনেকেই মনে করেন, মুজতবা আলী ছিলেন ১৯৫০-৬০ দশকে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। নিজের মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি তিনি ইংরেজি, ইতালিয়ান, আরবি, জার্মান, সংস্কৃত, ফরাসি, উর্দু সহ আরো ১৪ টি ভাষায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, এই সুবাদে তিনি অনুবাদক হিসেবেও বিভিন্ন ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
তুলনাত্মক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক মুজতবা আলীর ধর্মদর্শন সম্পর্কে জেষ্ঠ ভ্রাতা সৈয়দ মুর্তাজা আলী মন্তব্য করেছিলেন:
“তাঁর (মুজতবা আলীর) সাহিত্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। কিন্তু তাঁর এই উদারতার জন্য গোঁড়া স্বধর্মীরা তাঁকে কোনোদিন ক্ষমা করেননি।”
সাহিত্যিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মুজতবা আলীর রচনারীতি সম্পর্কে বলেছিলেন –
“প্রসাদগুণ বিশিষ্ট, সত্যকার হাস্যরসোজ্জ্বল, লঘু শৈলীর অথবা ভাবগম্ভীর চলতি বাংলা ভাষায় তিনি যে অসাধারণ দখল তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন, সেটি তাঁর মনের স্বাভাবিক শক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ও প্রসাদ উভয়ের গঙ্গা-যমুনা মিলনের ফল।”
প্রকাশনা, Publications
অতি সরল ভাষায় আড্ডার ঢঙ ব্যবহার করে কথা বলার ছলে লেখনশৈলীই ছিল মুজতবা আলীর জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ। তিনি কর্মসূত্রে বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন, কর্মক্ষেত্র ক্রমশ পরিবর্তন করেছেন এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেছেন; তাই তাঁর লেখায় ঘটেছে অনুরূপ বহুদর্শিতা এবং নিবিড় অনুধ্যানের প্রতিফলন । সৈয়দ মুজতবা আলীর রচিত বইয়ের সংখ্যা ৩০। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য রচনাগুলো হল:
● উপন্যাস-
– অবিশ্বাস্য (১৯৫৪)
– শবনম (১৯৬০)
– শহর-ইয়ার (১৯৬৯)
● ভ্রমণকাহিনী-
– দেশে বিদেশে (১৯৪৯) (কাবুল শহরের কাহিনী নিয়ে লেখা।)
– জলে ডাঙ্গায় (১৯৬০)
● ছোটগল্প-
– চাচা কাহিনী (১৯৫২)
– টুনি মেম (১৯৬৪)
– পঞ্চতন্ত্র (১৯৫২)
– ময়ূরকন্ঠী (১৯৫৭)
● রম্যরচনা-
– পঞ্চতন্ত্র (১৯৫২)
– ময়ূরকন্ঠী (১৯৫৭)
● গল্পমালা-
– রাজা উজির
– ধূপছায়া
– বেঁচে থাক সর্দি-কাশি
– পুনশ্চ
– পাদটীকা
– তীর্থহীনা
– কর্ণেল
– রাক্ষসী
– বিধবা বিবাহ
– ক্যাফে-দে-জেনি
– মা জননী
– বেল তুলে দু-দু’বার
– স্বয়ংবরা
– শবনম
– রস-গোল্লা (ইংরেজি)
– হিটলার
পুরস্কার প্রাপ্তি, Awards and recognition
জীবনের মহান কীর্তিগুলোর জন্য জীবদ্দশায় তথা মৃত্যুর পরবর্তী সময়েও সৈয়দ মুজতবা আলী বিভিন্ন সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘নরসিংহ দাস পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৬১ সালে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার পক্ষ থেকে তিনি “আনন্দ পুরস্কার” লাভ করেন। তাছাড়াও সাহিত্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার দরুন ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার সৈয়দ মুজতবা আলীকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ -এ ভূষিত করেছিল।
মৃত্যু, Death
সংস্কৃতির উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৬৯ বছর।
আলোর দিশারি ভগিনী নিবেদিতা ~ Sister Nivedita Biography in Bengali
উপসংহার, Conclusion
প্রকৃতপক্ষে এরূপ মহৎ ব্যক্তিবর্গের কোনদিনই মৃত্যু ঘটে না। তাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে, তাঁদের সাহিত্যসম্ভারে, বেঁচে থাকেন তাঁদের মতাদর্শ ও চিন্তাধারায়। বহুভাষাবিদ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর উদারনৈতিক মতাদর্শ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত তাঁর বিভিন্ন অমর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে দিয়ে তিনিও চিরকাল আপামর বাঙালির হৃদয়পটে অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর রচনায় প্রতিফলিত রম্যরস আজও পাঠকদের তথা সকল সাহিত্য প্রেমিকদের চিত্তবিনোদনে সক্ষম।
- ওপেনহেইমার এর জীবনী ও বিখ্যাত উক্তি সমূহ, Best Biography and quotes of Robert J Oppenheimer in Bengali
- ওয়াল্ট ডিজনির জীবনী, The Best Biography of Walt Disney in Bengali
- আবদুর রহমান, এক কিংবদন্তি অভিনেতা, The best biography of Abdur Rahman in Bengali
- মৃণাল সেনের জীবনী, Best Biography of Mrinal Sen in Bengali
- টমাস আলভা এডিসন এর জীবনী, Best Biography of Thomas Alva Edison in Bengali
Frequently asked questions
সৈয়দ মুজতবা আলী কে?
সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বিংশ শতকের একজন স্বনামধন্য বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার, এছাড়াও অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা হিসেবেও বিশেষ পরিচিত লাভ করেছেন
সৈয়দ মুজতবা আলী কবে ও কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
১৯০৪ খ্রীঃ ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্গত করিমগঞ্জে।
মুজতবা আলীর পিতার নাম কি?
সৈয়দ সিকান্দার আলি।
মুজতবা আলী রচিত গ্রন্থসমূহ কি কি?
দেশে বিদেশে, পঞ্চতন্ত্র (১ম ও ২য়), চাচাকাহিনী, ময়ূরকণ্ঠী, অবিশ্বাস্য, জলে ডাঙায়, ধূপছায়া, দ্বন্দ-মধুর, শবনম, ভবঘুরে ও অন্যান্য, বহু বিচিত্রা, রাজা-উজীর, কত না অশ্র“জল, মুসাফির, গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন।
মুজতবা আলী কবে মৃত্যুবরণ করেন?
১৯৭৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি।