“ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারবে কিন্তু আমার ভাবনাকে মারতে পারেব না।” – উক্তিটি হয়তো আমাদের সকলের কাছেই বেশ পরিচিত, এই বাণীর মধ্য দিয়ে এক দৃঢ় বৈপ্লবিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, এর বক্তা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রভাবশালী বিপ্লবী ভগৎ সিং। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী নেতা।

ভগৎ সিংয়ের জন্ম ও পরিবার পরিচয়, Birth and family identity of Bhagat Singh
ভগত সিং ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের লায়লপুর জেলার বাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল এবং বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত; তাঁর জন্ম হয়েছিল একটি জাট শিখ পরিবারে। পিতা কিষাণ সিং সান্ধুর এবং মাতা বিদ্যাবতীর সাত সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন ভগৎ। ভগতের নামের অর্থ ছিল “ভক্ত”। ভগৎরা চার ভাই এবং তিন বোন ছিলেন। ভগৎ সিং-এর বাবা এবং তার কাকা অজিত সিং ও স্বরণ সিং তৎকালীন সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তারা ১৯১৪ – ১৯১৫ সালের গদর আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

অজিত সিংহের নামে এক মামলা দায়ের করা হয়েছিল বলে পারস্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। অন্যদিকে ১৯২৫ সালের সংগঠিত কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ঘটনায় স্বরণ সিং দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অর্থাৎ বলাই বাহুল্য যে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর পরিবারও পূর্ব থেকেই জড়িত ছিল। অতীত কালে এই পরিবারের কোনো কোনো সদস্য মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। এছাড়া ভগতের ঠাকুরদাদা অর্জুন সিংহও ছিলেন দয়ানন্দ সরস্বতীর হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং আর্যসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার, Biography of famous vocalist Abdul Jabbar in Bengali
ভগৎ সিংয়ের শিক্ষাজীবন, Educational career of Bhagat Singh
বাঙ্গার গ্রামের স্কুলে কয়েক বছর পড়াশুনা করার পর, ভগৎ সিং পরবর্তী শিক্ষা অর্জনের জন্য লাহোরের দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে ভর্তি হন। কিশোর বয়সে ভগৎ সিং ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলেন এবং নৈরাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে, তিনি লাহোরের জাতীয় কলেজে যোগদান করেছিলেন, যা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় লালা লাজপত রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় ছাত্রদেরকে ব্রিটিশ ভারত সরকার কর্তৃক ভর্তুকি দেওয়া স্কুল ও কলেজগুলিকে পরিহার করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ছাত্র বয়স থেকেই ভগৎ সিং একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

যুগাবতার পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী, Biography of Shri Ramakrishna Paramahamsa in Bengali
বিপ্লবী সংগঠনে ভগৎ সিং এর যোগদান এবং অভিজ্ঞতা, Bhagat Singh’s involvement and experience in revolutionary organizations
ভগৎ সিং মাত্র তেরো বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। সেই সময় থেকেই তিনি প্রকাশ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরোধিতা করতে শুরু করেন এবং নিজের সরকারি স্কুল বই ও বিলিতি স্কুল ইউনিফর্ম পুড়িয়ে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে চৌরিচৌরার গণ-হিংসার ঘটনার সময় কয়েকজন ব্রিটিশ পুলিশকর্মীর মৃত্যু হওয়ায় গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। এতে ভগৎ হতাশ হয়ে যুব বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের পন্থায় ভারত থেকে ব্রিটিশদের শাসন পন্থা উৎখাত করার কথা প্রচার করতে শুরু করেন।

ভগৎ সিং কিশোর বয়সেই লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন কিন্তু একসময় বাল্য বিবাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং ‘নওজাওয়ান ভারত সভা’ তে যোগ দেন। সাহসী বিপ্লবী ভগৎ সিং ১৯২৩ সালে পাঞ্জাব হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন কর্তৃক আয়োজিত এক প্রবন্ধ রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে ছিলেন। তাঁর এই জয় পাঞ্জাব ও হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক সহ উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
তিনি পাঞ্জাব লেখকদের দ্বারা রচিত বেশ কিছু কবিতা এবং সাহিত্যও পাঠ করেছিলেন। ভগৎ এর পছন্দের কবি ছিলেন আল্লামা ইকবাল। এছাড়াও মার্ক্সবাদী সাহিত্য, বাকুনিন, টলস্টয়, আপটম সিনক্লেয়ার ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল দ্বারা রচিত সাহিত্যও গভীর মনযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন এই বিপ্লবী। সেখান থেকেই ইতিহাস শিক্ষক ও প্রফেসর বিদ্যালংকরের সাথে ভগতের পরিচিত হয় যার মাধ্যমে তিনি হিন্দুস্তান রিপাবলিক এসোশিয়েসন এর সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পান, সেখানে চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল এবং আসফাক উল্লা খানের মত বিশিষ্ট নেতারা ছিলেন। পরবর্তীতে নিজের মেধা, জ্ঞান ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে তিনি অচিরেই এই সংগঠনে নেতায় পরিণত হন।

তাঁর নেতৃত্ব সংগঠনটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয় এবং একে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে (এইচএসআরএ) রূপান্তরিত করে দেয়। ভগৎ সিং এবং তাঁর সংগঠনকে নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া হয় তখন তিনি ক্ষুরধার যুক্তিতে তা খন্ডন করেন। একসময় তিনি নিজের দল নিয়ে জেলে থাকা ভারতীয় ও ব্রিটিশ বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে টানা ৬৪ দিন অনশন চালিয়ে যান এবং সমর্থন আদায় করেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে ১৯২৬ সালের অক্টোবর মাসে নবরাত্রির সময় লাহোরে বোমা বিস্ফোরিত হয় এবং ভগৎ সিং-কে এই বোমা বিস্ফোরণে জড়িতদের মধ্যে থাকার দায়ে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পাঁচ সপ্তাহ পর ৬০,০০০ টাকা জামিন নিয়ে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি অমৃতসর থেকে উর্দু ও পাঞ্জাব পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন এবং নিজের লেখা সম্পাদনা করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে ‘কৃতি কিষান পার্টি’ নামক সভায় সমগ্র ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা বিভিন্ন বিপ্লবী নেতারা একটি সভায় মিলিত হয়েছিল। ভগৎ সিং ছিলেন ওই সভার সম্পাদক। পরবর্তীতে তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডদের দরুন তাঁকে সমিতির নেতা বানানো হয়।
করুণাময়ী রাণী রাসমণির জীবনী, Biography of Rani Rashmoni in bengali
বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের মৃত্যু বরণ, Death of revolutionary Bhagat Singh
ব্রিটিশ সরকার দ্বারা প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভগৎ এক ব্রিটিশ পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনার বিচারে ভগৎ সিং কে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর গলায় একই দিন ফাঁসির দড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ নির্ধারিত সময়ের থেকে ১১ ঘণ্টা আগেই তাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়।
“বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”

এই স্লোগান দিতে দিতে হাসি মুখে মৃত্যু বরণ করেছিলেন ভগৎ সিং। সেই মুহূর্ত ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ভারতীয় বিপ্লবীরা নিজের মহান আদর্শের জন্য কিভাবে প্রসন্ন চিত্তে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে পারে। বিপ্লবী ভগৎ সিং এর মৃত্যুবরণের পর থেকে দেশজুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্ররূপ ধারণ করে নেয়। তাঁর আত্মবলিদানের এই দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র ভারতীয় যুবসমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নয়, পাশাপাশি ভারতে সমাজতন্ত্রের উত্থানেও প্রভূত সহায়তা করেছিল।
জনপ্রিয় সংস্কৃতি ভগৎ সিংকে যেভাবে স্মরণে রেখেছে, Remembrance
২০০২ সালে ভগৎ সিংকে নিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘দ্য লিজেন্ড অব ভগৎ সিং’ নির্মিত হয়েছিল। এই ছবিতে ভগৎ সিং এর চরিত্রটি অজয় দেবগন দ্বারা অভিনীত ছিল।

বিশিষ্ট ধর্ম সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেনের জীবনী, Biography of Keshab Chandra Sen in Bengali
উপসংহার, Conclusion
বিপ্লবী শহীদ ভগৎ সিং এর মত মহান বিপ্লবীরা চিরকালই বেঁচে থাকেন আমাদের স্মরণে। তাই এদের মৃত্যুঞ্জয়ী বলা চলে। এরূপ বিপ্লবীদের চিন্তাধারা সকলের মনেই নিজের দেশের প্রতি প্রেম বাড়িয়ে তুলে এবং গর্বিত করে। আমাদের দেশকে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন করতে ভগৎ সিং এর আত্মবলিদান অনস্বীকার্য। ভগৎ সিং কে নিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ”ভগৎ সিং আজ কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি নন,তিনি একটি প্রতীক।আজ সারা দেশে যে বিপ্লব এবং বিদ্রোহের চিন্তা-আদর্শে প্রভাবিত হয়েছে,ভগৎ সিং সেই বিপ্লবী চিন্তায় জীবন্ত প্রতীক।”
- মোহাম্মদ রফির সেরা জীবনী, The Best biography of Mohammad Rafi in Bengali
- হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা- নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানী, Best Biography of Homi J. Bhabha in Bengali
- শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবনী, Best Biography of Srinivas Ramanujan in Bengali
- কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা, Kolkata-The City of joy- Best Details in Bengali
- বিক্রম সারাভাইয়ের জীবনী, Best Biography of Vikram Sarabhai in Bengali

Frequently asked questions
ভগৎ সিং কে?
ভগৎ সিং ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী নেতা।
ভগৎ সিং কবে ও কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
ভগত সিং ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের লায়লপুর জেলার বাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল এবং বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত।
ভগৎ সিং কে কেন ফাঁসি দেওয়া হয়?
ব্রিটিশ সরকার দ্বারা লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ভগৎ এক ব্রিটিশ পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন। এর বিচারে ভগৎ সিং কে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ভগৎ সিং কে কবে ফাঁসি দেওয়া হয়?
১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ।
