মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওল, Syed Alaol Biography in Bengali



আলাওল ছিলেন মধ্যযুগের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি। তাঁর পূর্ণনাম সৈয়দ আলাওল। তিনি আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসাবে সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন। নিজের দক্ষতার ভিত্তিতে মধ্যযুগের সমগ্র বাঙালি কবির মধ্যে ‘শিরোমণি আলাওল’ রূপে শীর্ষস্থান অধিকারী হয়ে উঠেন। আলাওল আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ক্রমে ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। আলাওল প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতি কর্মে বিশেষ পারদর্শী হয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন।

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওল

আলাওলের জন্ম ও শৈশব স্মৃতি, Birth and childhood days

আনুমানিক ১৬০৭ সালে কবি সৈয়দ আলাওলের জন্ম হয়। তৎকালীন মাদারীপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার জালালপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ এ কুতুবের অমাত্য। একবার জলপথে নৌকাযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে আলাওল ও তাঁর পিতা পর্তুগিজ জলদুস্যুদের আক্রমণের শিকার হন। এই ঘটনায় তাঁর পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। অতপর জলদস্যুরা আহত আলাওলকে বন্দী করে  ক্রীতদাস হিসাবে আরাকানে (বর্তমান মায়ানমারের একটি রাজ্য) নিয়ে যায়। তখন তাঁর বয়স কম ছিল। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় আরাকানেই কেটেছে । 

সন্দীপ মাহেশ্বরীর জীবনী~একটি অনুপ্রেরণা, Sandeep Maheshwari biography in bengali

আলাওলের শিক্ষা অর্জন, Education

অনেক অল্প বয়স থেকেই সৈয়দ আলাওল বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। হিন্দি, সংস্কৃত, ফরাসী প্রভৃতি ভাষা সম্পর্কে তিনি বহুল জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। এসবের পাশাপাশি তিনি সঙ্গীতশাস্ত্র সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

আলাওলের কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Career experiences

সৈয়দ আলাওল আরাকানে একজন দেহরক্ষী হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। পরে মহন্তের গৃহে নাটগীত ও  সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। একসময় তিনি যুদ্ধবিদ্যা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার জন্য আরাকান রাজ সাদ উমাদার এর অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। এর কিছুকাল পর তাঁর কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দিয়ে তিনি হয়ে পড়েন রাজসভার কবি। তখন আরাকানের রাজা ছিলেন রাজা সুধর্মা।

আলাওলকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন রাজার রাজসভার একজন প্রধান কর্মচারী মাগন ঠাকুর। তাঁর কবিপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটার পর আলাওল প্রধান অমাত্য কোরেশী মাগন ঠাকুরের (১৬৪৫-৫৮) আনুকূল্যে আরাকানের অমাত্যসভায় স্থান পান। পরে সৈয়দ মুসা (রাজ-অমাত্য), সুলায়মান (প্রধান অমাত্য), মুহাম্মদ খান (সৈন্যমন্ত্রী) ও মজলিস নবরাজ (রাজস্বমন্ত্রী) প্রমুখ রাজসভার সদস্যগণ এক এক করে কবি আলাওলকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তিনি তাঁদের নিকট থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং পুস্তক রচনার প্রেরণা পান। 

আলাওলের কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা

জয়া আহসানের জীবনকাহিনি | Biography of Jaya Ahsan in Bengali

আলাওলের কাব্য রচনাবলী, Poems and verses of Syed Alaol

কবি সৈয়দ আলাওলের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে বিস্তৃত আকারে বিশেষ কিছু জানা যায়নি, কিন্তু তাঁর রচিত কাব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনকাহিনীর বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা। তাঁর রচিত মোট কাব্যসংখ্যা সাত। আলাওল ছিলেন জীবনরসিক কবি। তিনি বহুভাষাবিদ এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত কবি ছিলেন বলেই বহুপাত্র হতে জীবন-রস আহরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতা ছিল অতুলনীয়। হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্রেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। আলাওলের রচনা সরল অথচ প্রগাঢ়। ‘পদ্মাবতী’ তাঁর শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িকা। আলাওলের কাব্যমালায় মাঝে মাঝে গান বা পদাবলি আছে। এগুলির কোনো কোনোটিতে তাঁর রচনাশক্তির বিশিষ্ট পরিচয় পাই।

আলাওলের প্রধান কাব্য ‘পদ্মাবতী’, যা ছিল কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য ‘পদুমাবৎ’-এর অনুবাদ। এ কাব্য রচনায় তিনি প্রায় তিন বছর ব্যয় করেন। আলাওল উক্ত কাব্যে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানবীয় প্রেমের কাহিনি পরিবেশন করেছেন। মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রচারমূলক বাংলা সাহিত্যধারার রচনা সমূহে এই ধরনের মানবীয় বিষয়ের অবতারণা নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলা সাহিত্যে এই কাব্যটির বিশেষ মূল্য রয়েছে। কাহিনি ও কাব্যগুণের জন্যে ‘পদ্মাবতী’ হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 

বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওলের ‘ পদ্মাবতী ‘ কাব্যের একটি অন্তরা :

“প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস

ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ

যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর

মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর “

সৈয়দ আলাওলের আখ্যানকাব্যগুলো হচ্ছে- পদ্মাবতী (১৬৪৮), সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী (১৬৫৯), সপ্তপয়কর (১৬৬৫), সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল (১৬৬৯) ও সিকান্দরনামা (১৬৭৩); নীতিকাব্য তোহফা (১৬৬৪) এবং সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য রাগতালনামা। রাগতালনামা ও গীতিপদসমূহ আলাওলের সাহিত্যে জীবনের প্রথম দিকের রচনা। এগুলিই ছিল তাঁর মৌলিক রচনা, অন্যগুলি অনুবাদমূলক কাব্য। পরবর্তী সময়ে আরাকানপতির আত্মীয় সৈয়দ মুসা’র উৎসাহে তিনি ‘সয়ফল মুলুক’ ও ‘বদিউজ্জামাল’ নামক দুটি পারস্য গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। মধ্যযুগের আরেক খ্যাতনামা কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত একটি কাব্য রচনা সম্পন্ন করেন আলাওল, যার নাম ছিল ‘সতীময়না’ । এছাড়া তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে : তোহ্‌ফা, দারাসেকেন্দারনামা প্রভৃতি। 

 আলাওলের কাব্য রচনাবলী

মহাকবি সৈয়দ আলাওল রচিত বিখ্যাত ‘সপ্ত পয়কর’ কাব্যে রাসুল বন্দনার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন:

“আদ্যেতি নিরুপ ছিল প্রভূর নির্বাকার।

চেতন স্বরুপ যদি হইল প্রচার।।

অতি ঘোরতর তমঃআকার বর্জিত।

মহা জ্যোতিমংয় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত।।

জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মহাম্মদ।

জগৎ বিজয়ী হৈতে পাইল সম্পদ।।

সপ্ত স্বর্গ উদ্যানের আদ্য নব ফুল।

বৃদ্ধি বাক্যে শিরোমণি ভূবনে অতুল।।

সেই পুস্প হৈতে আদ্যে আদম উজ্জল।

সকল কদর্মপূর্ণ সে-ই নির্মল।।”

এছাড়া আলাওল বহু বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। আলাওলের কাব্যের ভাব-ভাষা-রুচিতে নাগরিক শিক্ষা, বৈদগ্ধ্য ও অভিপ্রায় প্রভাব বিস্তার করেছে। দরবার-সংস্কৃতির সকল লক্ষণই তাঁর রচনাসমূহে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর লেখায় কাব্যিক আবেগের সঙ্গে বৌদ্ধিক চেতনার মিশ্রণ পাওয়া যায় বলে আলাওলকে ‘পন্ডিতকবি’ও বলা হয়।

লোকশিল্পের রূপকার তোফায়েল আহমদের জীবনী, Biography of Tofayel Ahmed, researcher of folk art in Bengali

আলাওলের প্রানবিয়োগ, Last days of Syed Alaol

কবি সৈয়দ আলাওল ১৬৫৯-৬০ সালে মুঘল রাজপুত্র শাহ সুজার দরবারে (আরাকান) আশ্রয়প্রার্থী হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রাজপুত্রের হত্যার পর আলাওলকে দরবার থেকে বের করে দেওয়া হয়। আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে ভিক্ষাবৃত্তির সাহায্যে স্ত্রী-পুত্রসহ প্রায় দশ বছর সেখানে অতিবাহিত করেন। শেষ বয়সে আধ্যাত্মিক গুরু মসউদ শাহ্ তাঁকে ‘কাদেরী খিলাফত’ প্রদান করেন। সেই স্থানে থাকাকালীন এক বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে পঞ্চাশ দিন কারাভোগ করতে হয়। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে ১৬৭৩ সালে উক্ত বিদ্রোহে আলাওল সপরিবারে নিহত হন। 

আলাওলের প্রানবিয়োগ

সম্মাননা, Awards and recognition

মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ট বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওলের মৃত্যুর বহুকাল পর, বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সম্মান, ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ – এর নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আলাওল হল’ নামক একটি পুরুষ প্রধান ছাত্রাবাস, তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।

সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মল্লিক এর জীবনকাহিনী ~ Biography of Pankaj Mullick in Bengali

উপসংহার, Conclusion

কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাহিত্য সম্ভারের অন্যতম সৃষ্টি কর্তা। বাংলা সাহিত্যের ধর্মীয় বিষয়বস্তুর গতানুগতিক পরিসীমায় রোমাঞ্চকর প্রণয়কাব্যধারা প্রবর্তনকারী হিসাবে মুসলমান কবিদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। এ সময়ে তাঁরা আরবি, ফার্সি তথা হিন্দি সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও ভাববৈচিত্র্য অনুসরণে কাব্য রচনার ক্ষেত্রে এক নবযুগ সৃষ্টি করেছিলেন। মধ্যযুগের এই পর্যায়ের কবিদের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বিচার অনুযায়ী কবি আলাওলকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৈয়দ আলাওলের অবদান অনস্বীকার্য।

আলাওলের অবদান

Frequently asked question

আলাওলের জন্ম সন কত?

১৬০৭ (আনুমানিক)।

আলাওলের জন্মস্থান কোথায়?

জোবরা গ্রাম, হাটহাজারি, চট্টগ্রাম; মতান্তরে ফতেহাবাদ পরগনা, ফরিদপুর।

আলাওল মূলত কী ছিলেন?

কবি ও পন্ডিত। বাংলা, সংস্কৃত, পারসি ও আরবি ভাষা জানতেন।

আলাওল আরাকানে কী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন?

আরাকান-রাজ উমাদারের রাজদেহরক্ষী অশ্বারোহী।

আলাওলের পিতা কী করতেন?

আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন।

Recent Posts